স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে আমরা বাঁশটাকে টেনে উপরে তুলে আনলাম। বাঁশের আগায় পতাকাটা বেঁধে যখন সেটাকে উপরে তুলছি তখন নিচ থেকে সব মুক্তিযোদ্ধা আনন্দে চিৎকার করে উঠল। পতাকা লাগানো বাঁশটাকে দেয়ালের ফাঁকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলাম। তারপর সেটার পাশে দাঁড়িয়ে নিচে তাকালাম। তখন খুব বিচিত্র একটা দৃশ্য চোখে পড়ল, কাঁকনডুবি গ্রামের সব মানুষ ছুটতে ছুটতে স্কুলের দিকে আসছে। শুধু পুরুষ মানুষ নয়, মেয়েরাও আসছে। ছোট বাচ্চারাও আসছে। সবাই আনন্দে চিৎকার করছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে জয় বাংলা! জয় বাংলা! মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল এসএলআর স্টেনগান উপরের দিকে মুখ করে গুলি করছে। আমরাও আমাদের স্টেনগান দিয়ে আকাশের দিকে এক পশলা গুলি করলাম।
আমি আর ডোরা নিচে তাকিয়ে দেখলাম পাইকার ভাইয়ের শরীরটাকে মাঠের মাঝখানে রেখে সেটা একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ তার পাশে বসে তাকে ধরে রেখেছে। আমি হঠাৎ এক পাশে উত্তেজিত গলার শব্দ শুনতে পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে দেখি কয়েকজন ছেলে মিলে মতি রাজাকারকে ধরে আনছে, সবাই তাকে কিল-ঘুষি মারছে। একজন তার চুল ধরে টেনে আনছে তাই মাথা নিচু করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকে হাঁটতে হচ্ছে। সবাই মিলে হঠাৎ তাকে মারতে শুরু করল, সে মনে হয় পিটুনি খেয়েই মরে যেত। মাসুদ ভাই তাকে পিটুনি থেকে উদ্ধার করে মিলিটারিদের পাশে বসিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মাঝে অন্য রাজাকারদেরও ধরে আনা হলো। তারাও প্রথমে কিছু মার খেল, তারপর দুই হাত মাথার পেছনে রেখে স্কুলের মাঠে বসে রইল।
আমি হঠাৎ মেয়েলি গলায় একটা চিৎকার শুনলাম, রঞ্জু!
তাকিয়ে দেখি লতিফা বুবু। লতিফা বুবুকে দেখে আমার কী যে ভালো লাগল সেটা আমি কাউকে বোঝাতে পারব না। নিচ থেকে লতিফা বুবু আমার আর ডোরার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে। আমি আর ডোরাও হাত নাড়লাম। হঠাৎ ডোরা চোখ বড় বড় করে বলল, ঐ যে আম্মু!
আমি তাকিয়ে দেখি ডোরার বড় বোন নোরা আর তার মা প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন। ডোরা স্কুলের ছাদ থেকে চিৎকার করে ডাকল, আম্মু!
আমি দেখলাম ডোরার আম্মু কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ডোরা বলল, চল, নিচে নামি।
আমি বললাম, চল।
আমরা নিচে নামামাত্র চারদিক থেকে সবাই আমাদের ঘিরে দাঁড়াল। আমি মামুনকে দেখলাম, সে জাপটে ধরে আমাকে ঝাঁকাতে লাগল। ডোরাকে ধরে তার আম্মু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। এর মাঝে লতিফা বুবুও আমাকে আর ডোরাকে জাপটে ধরে ফেলল। আমার তখন নানির কথা মনে পড়ল। আমার বুড়ো নানি তো এখানে আসতে পারবে না। আমি তখন সবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাইরে বের হয়ে এলাম।
মাসুদ ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে নিচু গলায় কিছু একটা বলছিল, আমি তাঁর কাছে গিয়ে বললাম, মাসুদ ভাই, আমি আমার বাড়ি থেকে আসি?
মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাথে কাউকে দেব?
না। লাগবে না।
তাড়াতাড়ি চলে এসো, আমরা পাইকারের জানাজা পড়াব, দাফন করব।
ঠিক আছে বলে আমি ছুটতে লাগলাম। স্কুলঘর থেকে বের হয়ে সড়কের ওপর দিয়ে ছুটতে থাকি, কালী গাংয়ের তীর ধরে ছুটতে থাকি, বলাই কাকুর চায়ের স্টলের পাশ দিয়ে ছুটতে থাকি, কাজী বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই, হাঁপাতে হাঁপাতে আমি উঠানে পা দিলাম। নানি বারান্দার একটা জলচৌকিতে বসে আছে। আমি কখনো নানিকে কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে দেখিনি। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে এত অবাক লাগছিল যে আমি এক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। নানি অন্যমনস্কভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল, তাই আমাকে দেখতে পায়নি। আমি ডাকলাম, নানি।
নানির শরীরে কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল, তারপর নানি খুব ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল। মনে হচ্ছিল নানি বুঝি মাথা তুলে তাকাতে ভয় পাচ্ছে, যদি মাথা তুলে দেখে আসলে কেউ নাই!
নানি আমার দিকে তাকাল, তারপর হাত দুটো বাড়িয়ে দিল। আমি ছুটতে ছুটতে এসে নানিকে জড়িয়ে ধরলাম। নানি তার শুকনা দুর্বল হাত দিয়ে আমাকে ধরল। এমনভাবে আমাকে ধরে রাখল যে মনে হলো নানির বুঝি মনে হচ্ছে তার হাতটা একটু আলগা করলেই আমি বুঝি হারিয়ে যাব। কত দিন থেকে আমি এই মুহূর্তটার কথা ভাবছিলাম! আমি কত দিন থেকে ঠিক করে রেখেছিলাম প্রথমবার যখন নানির সাথে দেখা হবে তখন নানিকে বলব, জানো নানি–আমি কিন্তু সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা! আমি আর ডোরা! নানি, আমরা সত্যি সত্যি যুদ্ধ করেছি, মাসুদ ভাই বলেছে আমরা না থাকলে আজকে যুদ্ধে আমরা জিততে পারতাম না। আমরা পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ নামিয়ে স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ টানিয়েছি। ঐ যে গুলির শব্দ শুনছ নানি, এটা কিন্তু যুদ্ধের গুলি না! এইটা আনন্দের গুলি!
আমি নানিকে কিছুই বলতে পারলাম না, নানিকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম।
.
শেষ কথা
কাঁকনডুবি গ্রামে যুদ্ধ করে মিলিটারি ক্যাম্প দখল করে নেয়ার ঠিক দশ দিন পরে ঢাকায় পাকিস্তানি মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করেছিল।
কাঁকনডুবি গ্রামটি যেভাবে স্বাধীন হয়েছিল, সেদিন ঠিক সেইভাবে যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল।