.
২৫.
ডোরা কিছুক্ষণ মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই মানুষটা তোকে টর্চার করেছিল?
নিজে করে নাই। আরেকজনকে অর্ডার দিয়েছিল।
একই কথা। ডোরা স্কুলটার দিকে তাকিয়ে বলল, কোনখানে তোকে টর্চার করেছিল?
ক্লাস নাইন সেকশন বি।
সেইটা কোথায়?
আয় দেখাই। বলে আমি ডোরাকে আমাদের স্কুলের ক্লাস নাইন সেকশন বি’তে নিয়ে গেলাম। রুমটা খালি, শুধু মেঝেতে শুকনো রক্ত। ভাঙা কয়েকটা বেঞ্চ এখানে-সেখানে ছেঁড়া কাপড়। কয়েকটা জংধরা দা-চাকু-লোহার রড পড়ে আছে। ডোরা বলল, কী ভয়ংকর।
আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, কেন ডোরার কাছে রুমটা এত ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এটা তো একটা খালি ঘর এখানে কেউ নাই, আমাকে যেদিন ধরে এনেছিল, সেদিন রুমটা ছিল ভয়ংকর।
আমরা যখন ঘরটা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি, ঠিক তখন মনে হলো পাশের ঘরে কোনো মানুষ নিচু গলায় কথা বলল। আমি স্টেনগানটা ধরে এগিয়ে গেলাম। রুমটার দরজার কড়া দুটো একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। দরজাটা খুলে আমি আর ডোরা ভেতরে উঁকি দিলাম। দরজা-জানালা বন্ধ, আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম ঘরের ভেতরে বেশ কয়েকটা মেয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। ময়লা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে, মনে হচ্ছে শরীরে আর কোনো কাপড় নেই–শীতে তিরতির করে কাঁপছে।
মেয়েগুলো আমাদের দিকে তাকাল, চোখের দৃষ্টি এত আশ্চর্য যে আমার বুকটা ধক করে উঠল। এত তীব্র দৃষ্টি আমি কখনো দেখিনি, সেখানে কোনো ভয় বা আতঙ্ক নেই, দৃষ্টিটা আশ্চর্য রকম তীক্ষ্ণ। আমি কী বলব, বুঝতে পারলাম না। ঢোঁক গিলে বললাম, আপনাদের আর কোনো ভয় নাই। যুদ্ধ শেষ।
কথাটা শুনে মনে হলো তাদের মাঝে একটুও পার্থক্য হলো না, তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হলো, যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা শেষ না হলেও তাদের কিছু আসে যায় না। আমার মনে হলো, হয়তো তারা আমার কথাটা বুঝতে পারেনি। আমি আবার বললাম, খোদার কসম। যুদ্ধ শেষ।
লালচে চুলের একটা মেয়ে, যার চোখের দৃষ্টি সবচেয়ে ভয়ংকর আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলল, তোমাদের যুদ্ধ শেষ। আমাদের যুদ্ধ শুরু।
আমি এই বিচিত্র উত্তরটা শুনে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখন ডোরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুই যা। ঘর থেকে বের হয়ে যা। মাকে খুঁজে বের করে নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি।
আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, ডোরা শুনতে রাজি হলো না, আমাকে বলল, যা, তুই যা। তারপর মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ছেলেদের কাপড় পরে থাকলেও আসলে আমি মেয়ে। আমি আপনাদের কাছে আসি?
মেয়েগুলো অবাক হয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলল না। ডোরা আস্তে আস্তে তাদের দিকে দুই পা এগিয়ে গেল।
সবগুলো মেয়ে আমাদের দিকে তাকালেও একজন তখনো মাথা নিচু করে মুখ ঢেকে রেখেছে। আমি তার চেহারা দেখতে পারছি না যেটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা বুঝি লতিফা বুবু! লতিফা বুবু?
আমি এক পা এগিয়ে গেলাম, ডোরা তখন চিৎকার করে বলল, তুই বের হয়ে যা।
আমি কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো বের হয়ে এলাম। আমি এদিকে সেদিকে খুঁজে মাসুদ ভাইকে বের করলাম। তার হাত ধরে বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হয়েছে?
স্কুলের একটা ঘরে অনেকগুলো মেয়ে।
মাসুদ ভাইয়ের মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল। আমি বললাম, ডোরা ভেতরে আছে, আমাকে বলেছে মা’কে খুঁজে নিয়ে যেতে।
মাসুদ ভাই বলল, আমি দেখছি।
আমি বারান্দায় বসে রইলাম। মাসুদ ভাই ছোটাছুটি করে মাকে নিয়ে এল। সাথে আরো কয়েকজন মহিলা। তারা ঘরের ভেতরে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর ডোরা বের হয়ে এল। আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে আমার কাছে এগিয়ে এল। আমি বললাম, ডোরা।
ডোরা বলল, কী?
আমার মনে হলো—
কী মনে হলো?
মনে হলো ভেতরে লতিফা বুবু আছে।
ডোরা মাথা নাড়ল। বলল, না। লতিফা বুবু নাই।
সত্যি?
সত্যি। ডোরা আমার পাশে বন্ধে বলল, আমাদের লতিফা বুবু নাই, কিন্তু অন্য লতিফা বুবু আছে। অন্য জোহরা আপু আছে। অঞ্জনা বৌদি আছে।
আমরা দুইজন চুপ করে বসে রইলাম।
.
মাসুদ ভাই কোথা থেকে জানি একটা বাংলাদেশের পতাকা বের করেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, দেন কমান্ডার। পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটা নামিয়ে এটা টানিয়ে দিই।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বলল, তোমরা না, এই ফ্ল্যাগটা টানাবে রঞ্জু আর খোকন, মানে রঞ্জু আর ডোরা! তারপর পতাকাটা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, তোমরা পারবে না?
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, পারব।
মাসুদ ভাই বলল, মাঠের মাঝখানে টানালে হবে না, স্কুলের উপরে উঠে সেখানে একটা লম্বা বাঁশ বেঁধে টানাতে হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে!
মাসুদ ভাই পতাকাটা আমাদের হাতে দিয়ে বলল, যাও।
আমি আর ডোরা পতাকাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। মাঠের মাঝখানে পুঁতে রাখা বাঁশটা টেনে তুলতেই মুক্তিযোদ্ধারা কাড়াকাড়ি করে পাকিস্তানি পতাকাটা খুলে সেটাকে পা দিয়ে মাড়াতে লাগল। একজন একটা ম্যাচ দিয়ে ফ্ল্যাগটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। আমি দেখলাম পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো পাথরের মতো মুখ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর ডোরা বাঁশটাকে নিয়ে স্কুলের বিল্ডিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। বাঁশটাকে স্কুলের দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে বিল্ডিংয়ের দেয়ালের ফাঁকফোকরে পা রেখে দুইজন উপরে উঠতে থাকি। আমরা অনেকবার স্কুলের ছাদে উঠেছি এখন গোলাগুলিতে স্কুলের দেয়ালে অনেক গর্ত হয়েছে, তাই উপরে ওঠা অনেক সোজা হয়েছে। ডোরা অবশ্যি আমার মতো এত সহজে উঠতে পারছিল না, তাই থেকে থেকে তাকে হাত ধরে সাহায্য করতে হচ্ছিল।