আমি আর ডোরা উঠে দাঁড়ালাম, পুরো স্কুলটা একটা ধ্বংসস্তূপ। এখানে-সেখানে বড় বড় গর্ত। পাকিস্তানি মিলিটারি মরে পড়ে আছে। স্কুলের মাঠে অনেকগুলো মিলিটারি দুই হাত মাথার পেছনে দিয়ে বসে আছে। তাদের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নাই। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের দিকে অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার পায়ে গুলি লেগেছে, সে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছে, একজন তার পায়ে ব্যান্ডেজ লাগানোর চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
আমাকে আর ডোরাকে দেখে মাসুদ ভাই এগিয়ে এল আমাদের পিঠে হাত রাখল আর আমরা দুইজন ভেউ ভেউ করে কেঁদে দিলাম। মাসুদ ভাই হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের দুইজনকে জড়িয়ে ধরল আর আমরা কাঁদতেই থাকলাম। মাসুদ ভাই ফিসফিস করে বলল, তোমাদের দুইজনের জন্য আমরা আজকে যুদ্ধে জিতেছি। পাইকারের মতো তোমাদের গুলি খাওয়ার কথা ছিল। তোমরা যেভাবে গিয়েছ তোমাদের বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু তোমরা বেঁচে আছ। তোমরা গুলি খাও নাই, খোদা নিজের হাতে তোমাদের রক্ষা করেছে। নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য দোয়া করেছে। পাইকারের দোয়া খোদা শুনেছে। বুঝেছ? পাইকার এখন ওপর থেকে তোমাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে! তোমরা কেঁদো না–পাইকার কখনো কাঁদে নাই
আমরা তবু কাঁদতেই থাকলাম।
ঠিক তখন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা একজন মিলিটারির পেছনে একটা রাইফেল ধরে তাকে ঠেলে ঠেলে মাসুদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে এল। কাছে এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে মাসুদ ভাইয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে একজন বলল, কমান্ডার–এইটাকে একটা বাংকারে পাওয়া গেছে। মনে হয় অফিসার।
আমি মিলিটারিটার মুখের দিকে তাকালাম, সাথে সাথে তাকে চিনতে পারলাম, মানুষটা মেজর ইয়াকুব। মেজর ইয়াকুবের মুখ পাথরের মতো কঠিন, সেখানে কোনো ভয়, আতঙ্ক, ক্রোধ বা অন্য কোনো অনুভূতির চিহ্ন নাই। মাসুদ ভাই মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে থেকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তুমি মেজর ইয়াকুব?
মেজর ইয়াকুব কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল, উত্তর দাও। তুমি মেজর ইয়াকুব?
মেজর ইয়াকুব ইংরেজিতে বলল, হ্যাঁ। আমি মেজর ইয়াকুব।
মাসুদ ভাই হঠাৎ আমাকে ধরে মেজর ইয়াকুবের সামনে দাঁড়া করাল, বলল, তুমি এই ছেলেটাকে চেনো?
মেজর ইয়াকুব আমার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে আমাকে চিনতে পারল, তার চোখে এক সেকেন্ডের জন্য একটা অস্বস্তি খেলা করল, কিন্তু সে কোনো কথা বলল না।
মাসুদ ভাই আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি চেনো এই ছেলেটাকে? মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না, তখন মাসুদ ভাই আবার ধমক দিয়ে উঠল, চিৎকার করে বলল, উত্তর দাও! চেনো এই ছেলেটাকে?
মেজর ইয়াকুব মাথা নাড়ল। মাসুদ ভাই ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই বাচ্চা ছেলেটার ওপরে অত্যাচার করেছিলে?
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। খুব ধীরে ধীরে অপরাধীর মতো তার মাথা নিচু করল। মাসুদ ভাই বলল, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও মেজর ইয়াকুব। তুমি এই বাচ্চা ছেলের ওপর কি অত্যাচার করেছিলে?
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই আমাকে ঘুরিয়ে দাঁড়া করে পিঠের শার্টটা টান দিয়ে উপরে তুলল, আমার পিঠে মিলিটারির চাবুকের দাগগুলো দেখিয়ে বলল, এই দেখো! তোমরা এই বাচ্চাটাকে কীভাবে অত্যাচার করেছিলে, নিজের চোখে দেখো।
মেজর ইয়াকুব কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই হিংস্র গলায় বলল, এই বাচ্চাটির কাছে মাফ চাও। তার ওপরে তোমরা যে অত্যাচার করেছ সেইজন্য তার কাছে মাফ চাও।
মেজর ইয়াকুব একবার মাথা তুলে তাকাল, তারপর আবার মাথা নিচু করল। মাসুদ ভাই হঠাৎ চিৎকার করে বলল, মাফ চাও ছেলেটার কাছে। না হলে আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।
মাসুদ ভাই এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে মেজর ইয়াকুব পর্যন্ত চমকে উঠল। তার চিৎকার শুনে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা কী হচ্ছে দেখার জন্য এগিয়ে এল।
মাসুদ ভাই আমাকে ধরে রেখেছিল, তাই আমি বুঝতে পারছিলাম যে প্রচণ্ড ক্রোধে তাঁর শরীর থর থর করে কাঁপছে। হঠাৎ করে আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাসুদ ভাই মেজর ইয়াকুবের কাছে এগিয়ে গেল, তারপর তার ডান হাতটা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার গালে এত জোরে একটা চড় দিল যে মেজর ইয়াকুব হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। মেজর ইয়াকুবের মতো এত বড় একজন মানুষকে শুধু চড় দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া সম্ভব, সেটা আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।
মেজর ইয়াকুবের ফর্সা গালটা লাল হয়ে উঠেছে। মাসুদ ভাইয়ের হাতের পাঁচটা আঙুলের ছাপ তার গালে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেজর ইয়াকুব খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মাসুদ ভাই আবার তার দিকে এগিয়ে গেল তখন মেজর ইয়াকুব খুব নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে আমাকে বলল, বেটা, হাম সরি হায়।
আমি মেজর ইয়াকুবের মুখে থুঃ করে থুথু দিয়ে বললাম, তোম আসলে সরি নেহি হয়। তোম আসলে এখন ভয় পাইতা হায়!
মেজর ইয়াকুব হাত দিয়ে তার চোখ থেকে আমার থুথুটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা করল। মাসুদ ভাই দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে বলল মেজর ইয়াকুবকে নিয়ে অন্যদের সাথে বসিয়ে রাখার জন্য। একটু পরে দেখলাম সে অন্যদের মতো দুই হাত উপরে তুলে মাথার পেছনে হাত দিয়ে বসে আছে। অন্যান্য পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো একটু অবাক হয়ে তাদের মেজরের দিকে তাকিয়ে আছে।