আমি আর মামুন যখন স্কুল থেকে বাড়ি যাচ্ছি তখন লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে ফালতু মতির সাথে দেখা হলো। একটা হাফ হাতা শার্টের হাতাটা আরেকটু গুটিয়ে রেখেছে, লুঙিটার একটা কোনা খুব কায়দা করে ধরে তুলে রেখেছে। মনে হয় পায়ে বরারের কালো জুতোগুলো যেন দেখা যায় সে জন্য।
আমাদের দেখে মুখের একটা কোনা উপরে তুলে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, ইস্কুল থেকে আসছিস?
আমরা মাথা নাড়লাম।
ফালতু মতি জিজ্ঞেস করল, লেখাপড়া হয় ইস্কুলে?
মামুন বলল, হয়।
মতি মুখটা আরো বাঁকা করে বলল, নাকি খালি রাজনীতি হয়?
আমরা খুবই অবাক হলাম, স্কুলে কেন রাজনীতি হবে? এটা আবার কী রকম কথা? মামুন বলল, কথাটা বুঝলাম না মতি ভাই।
নূতন একটা মাস্টার আসছে সে নাকি স্কুলের পোলাপানদের নিয়ে রাজনীতি করছে।
এবারে আমরা ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম, মাসুদ ভাইয়ের কথা। বলছে। ক্লাসে আমাদের সাথে কী বলেছে, সেটা ফালতু মতি জানল কেমন করে? মতি বলল, কলেজের ছাত্র কোনো পাস দেয় নাই কিছু নাই তারে মাস্টার বানাল কোন আক্কেলে? ইস্কুল কি হেডমাস্টারের বাপের সম্পত্তি? যারে-তারে নিয়া আসবে?
আমরা কিছু বললাম না, মতির সাথে কথা যত কম বলা যায়, তত ভালো। সে বুকপকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করল, আরেকটা পকেট থেকে ম্যাচ বের করল, সে যে অন্যদের মতো বিড়ি খায় না, সিগারেট খায় সেটা বোঝাবার জন্য সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে আমাদের মুখে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোদের চ্যাংড়া মাস্টারকে বলিস মাস্টারি করার আগে যেন একটা-দুইটা পাস দেয়।
আমরা মাথা নাড়লাম। মতি তখন আবার তার লুঙিটার কোনা ধরে একটু উপরে তুলে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। আমি আর মামুন কিছুক্ষণ মতিকে হেঁটে যেতে দেখলাম। মামুন গলা নামিয়ে বলল, মতি ভাই এইখানে হাঁটাহাঁটি করে কেন জানিস?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
তার লতিফা বুবুরে বিয়ে করার শখ। সেই জন্য সেজেগুঁজে এই বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করে।
মতি বিয়ে করবে লতিফা বুবুরে দৃশ্যটা চিন্তা করেই আমি আর মামুন হি হি করে হাসতে লাগলাম!
আমি আর মামুন হেঁটে হেঁটে আরেকটু সামনে গিয়েছি, লতিফা বুবুদের বাড়ির বাংলাঘরের পাশে দেখলাম শাড়ি পরা একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা আমাদের ডাকল, এই রঞ্জু, মামুন–
আমরা ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মহিলাটা আসলে আমাদের লতিফা বুবু, শাড়ি পরলে সব মেয়েকে এত বড় দেখায়! আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, লতিফাবু!
লতিফা বুবু হাসল, বলল কী হলো? তোরা আমার কোনো খোঁজ নিতেও আসবি না?
আমরা কী বলব বুঝতে পারলম না, লতিফা বুবু ছিল আমাদের লিডার, তার পিছু পিছু আমরা সারা কাঁকনডুবি চষে বেড়াতাম, সবার খোঁজ নিতাম। সেই লতিফা বুবু বলছে আমরা তার খোঁজ নিই না। আমি বললাম, লতিফাবু, তোমাকে দেখে আমি চিনতে পারি নাই। ভেবেছি অন্য কেউ।
লতিফা বুবু কিছু বলল না, কিছুক্ষণ আমাদের দেখল, আমাদের হাতের বইগুলোর দিকে তাকাল, তারপর বলল, দেখি তোদের বইগুলো।
আমি বইগুলো দিলাম, মাত্র কয়েক দিন হলো ক্লাস শুরু হয়েছে এর মাঝেই বইগুলো কাহিল হয়ে গেছে। লতিফা বুবু অবশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখল তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফালতু মতির লেখাপড়া করার কোনো শখ নাই তার পরও সে তিনবার ম্যাট্রিক দিয়েছে, আর লতিফা বুবুর এত লেখাপড়া করার শখ তার স্কুল বন্ধ করে তাকে বাড়িতে আটকে রেখেছে!
মামুন জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কী করো লতিফাবু?
এই তো সংসারের কাজ করি।
বই পড় না?
বই? বই আমাকে কে দেবে?
আমি বললাম, আমাদের স্কুল লাইব্রেরি থেকে তোমাকে বই এনে দেব?
লতিফা বুবুর চোখ চক চক করে উঠল, দিবি? এনে দিবি?
মামুন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো ভালো বই নাই। সব পুরান পুরান বই।
লতিফা বুবু মাথা নেড়ে বলল, হোক পুরান। তুই এনে দে।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিক আছে লতিফাবু।
আমরা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম কিন্তু কথা বলার কিছু খুঁজে পেলাম না। কী আশ্চর্য ব্যাপার একসময় আমাদের কথা বলা নিয়ে কোনো সমস্যা হতো না, কে কার আগে কী বলবে, সেটা নিয়েই ঝগড়া লেগে যেত। ধান ক্ষেতে লতিফা বুবু হয়তো একটা ফড়িং ধরেছে, ধরে বলত, এই দেখ। কেমন করে হেলিকপ্টার বানাতে হয় তোদের দেখাই।
আমরা লতিফা বুবুকে ঘিরে দাঁড়াতাম, লতিফা বুবু তখন একটা লম্বা চোরাকাটা নিয়ে ফড়িংয়ের পেছনে ঠেলে ঢুকিয়ে দিত। তারপর ফড়িংটা ছেড়ে দিয়ে বলত, এই দেখ।
বেচারা ফড়িং সেই চোরাকাটা নিয়ে ওড়ার চেষ্টা করত, আমরা আনন্দে হাত তালি দিয়ে হি হি করে হাসতাম। মামুন বলত, হেলিকপ্টারের পাখা থাকে উপরে–এইটার পাখা উপরে হয় নাই।
লতিফা বুবু মামুনের মাথায় চাটি মেরে বলত, চুপ কর। তুই বেশি জানিস?
ঠিক তখন হয়তো আরেকজন চিৎকার করে লাফানো শুরু করেছে, তার পায়ে জোঁক ধরেছে। লতিফা বুবু বাঘ–সিংহকেও ভয় পেত না কিন্তু জোঁককে খুব ভয় পেত, দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকত, টেনে ছুটিয়ে দে–ছুটিয়ে দে।
আমরা জোঁক টেনে ছুটিয়ে এনে তখন সেটা দিয়ে লতিফা বুবুকে ভয় দেখাতাম, লতিফা বুবু একেবারে হাত জোর করে বলত, ভাইডি ভাইডি ভাইডি তোর আল্লাহর কসম লাগে, বড় পীর সাহেবের কসম লাগে–খোদার কসম লাগে–কাছে আনিস না। ফেলে দে পা দিয়ে পিষে ফেল–