যখন সূর্যের প্রথম আলোটা আমাদের ওপর এসে পড়ছে তখন পাইকার ভাই গুলি খেল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, হঠাৎ যন্ত্রণায় একটু শব্দ করে পাইকার ভাই এক পাশে ঢলে পড়ল। আমি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে পাইকার ভাই?
পাইকার ভাই নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, কিছু না! কেউ একজন এলএমজিটা ধরো।
আমি আবার চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, পাইকার ভাই! কী হয়েছে?
পাইকার ভাইকে উত্তর দিতে হলো না, আমি দেখতে পেলাম টকটকে লাল রক্তে তার কাপড় ভিজে এসেছে, মাটিটা রক্তে ভিজে যাচ্ছে। ডোরা ডুকরে কেঁদে উঠল, পাইকার ভাই!
পাইকার ভাই অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল, অনেক কষ্ট করে ডোরার মাথায় হাত রাখল, ফিসফিস করে বলল, কাদার কিছু নাই। কাঁদে না বোকা মেয়ে।
আমি পাইকার ভাইকে ধরে চিৎকার করে বললাম, পাইকার ভাইয়ের গুলি লেগেছে–গুলি লেগেছে–
মাথার ওপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, তার মাঝে কয়েকজন বুকে ঘষে ঘষে চলে এল, তাঁকে টেনে পেছনে সরিয়ে নিতে চাইছিল, পাইকার ভাই হাত দিয়ে থামাল, বলল, আমাকে টানাটানি করো না তোমরা যাও–
একজন টান দিয়ে তাঁর শার্টটা খুলে গুলির ক্ষতটা দেখার চেষ্টা করল, গল গল করে রক্ত বের হচ্ছে, শার্টটা দিয়ে আবার ক্ষতটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। পাইকার ভাই দুর্বলভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল, ফিস ফিস করে বলল, তোমরা যাও! নিজের পজিশনে যাও, খোদার কসম–
এদিক থেকে গুলি কমে এসেছে দেখে কয়েকটা মিলিটারি বাংকার থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছিল, তাই সবাই আবার নিজেদের অস্ত্র হাতে গুলি করতে শুরু করেছে। মিলিটারিগুলো আবার বাংকারে ঢুকে গেল।
.
আমি পাইকার ভাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলাম–ডোরা সাবধানে তাঁর মাথাটা কোলে তুলে নিল কানের কাছ দিয়ে বিপজ্জনকভাবে শিসের মতো শব্দ করে কয়েকটা গুলি চলে গেল, ডোরা সেটা লক্ষ্যও করল না।
পাইকার ভাই ফিসফিস করে কিছু একটা বলল, আমি তার কথা ঠিক শুনতে পারলাম না, মাথাটা তাঁর মুখের কাছে নিয়ে গেলাম, তখন শুনলাম ফিসফিস করে বলল, দেশ স্বাধীন হবে খোদার কসম–
ডোরা কাঁদতে কাঁদতে বলল, যাবেন না পাইকার ভাই। যাবেন না–থাকেন। আপনি থাকেন।
পাইকার ভাই হাসার চেষ্টা করল, বলল, আছি। আমি আছি। আমি যাব না–আমি সব সময় থাকব আমি দেখলাম তার ঠোঁটের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা রক্ত বের হয়ে চিবুক দিয়ে গড়িয়ে পড়ল। ডোরা হাত দিয়ে রক্তটা মুছে দেয়, তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। পাইকার ভাই হাতটা তুলে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল ডোরা হাতটা ধরে রাখল। আমি আরেকটা হাত ধরে রাখলাম। তাঁর নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, একবার চোখ খুলে তাকাল, কী বিচিত্র একটা দৃষ্টি, তারপর চোখ বন্ধ করল, আর তাকাল না।
পাইকার ভাই গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার কারণে সবার মন ভেঙে গেল। যুদ্ধ প্রায় থেমেই যাচ্ছিল, সবাই অস্ত্র গুটিয়ে চলেই যাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত গেল না শুধুমাত্র আমার আর ডোরার কারণে।
ডোরার কোলে মাথা রেখে পাইকার ভাই যখন মারা গেল তখন ডোরা আমার দিকে তাকাল, আমি ডোরার দিকে তাকালাম। ডোরার চোখ টকটকে লাল, চোখ মুছে ডোরা বলল, চল, তুই আর আমি গিয়ে ঐ বাংকারটাতে দুইটা গ্রেনেড ফেলে আসি।
বাংকারে মেশিনগান বসিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি করছে, এর মাঝে সেই বাংকারে গিয়ে আসলে কেউ কোনো দিন একটা গ্রেনেড ফেলে আসতে পারবে না। কিন্তু আমি সেটা চিন্তা করলাম না। আমি কিড়মিড় করে দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, চল।
তখন স্টেনগানটা পিঠে ঝুলিয়ে হাতে একটা করে গ্রেনেড নিয়ে আমি আর ডোরা ক্রলিং করে এগোতে লাগলাম। সবাই চিৎকার করে উঠল, কী করো! কী করো! আমি আর ডোরা কিছুই শুনলাম না একেবারে মাটির সাথে ঘষে ঘষে এগোতে থাকলাম। আর তখন আমাদের পিছু পিছু অন্য সব মুক্তিযোদ্ধাও বুকে ঘষে ঘষে এগোতে লাগল। শুয়ে শুয়ে গুলি করে আর অগ্রসর হয়। হঠাৎ মনে হতে লাগল সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে উড়ে যাবে–মনে হয় আমার হাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার সেই অস্ত্র! আমার স্পষ্ট মনে আছে কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ আমি উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, জয় বাংলা! তারপর ছুটতে ছুটতে বাংকারের কাছে গিয়ে দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের পিনটা টেনে খুলে ফেললাম–সূক্ষ্ম একটা ধোঁয়া বের হলো, চার সেকেন্ড পর এটা ফাটবে, আমি মনে মনে গুনলাম এক হাজার এক, এক হাজার দুই, এক হাজার তিন–তারপর গ্রেনেডটা বাংকারের ভেতর ছুড়ে দিলাম। দেখলাম বাংকারের ভেতর একজন মিলিটারি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার অবাক হবারও শক্তি নাই।
প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হলো, সাথে সাথে আরেকটা। নিশ্চয়ই এটা ডোরার গ্রেনেড আর ঠিক তখন সব মুক্তিযোদ্ধা জয় বাংলা বলে চিৎকার করতে করতে হাতের অস্ত্র দিয়ে গুলি করতে করতে স্কুলের ভেতরে ঢুকে গেল।
আমি উঠে বসলাম, কাছেই ডোরা, সে কেমন জানি অবাক হয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। স্কুলের ভেতরে যে প্রায় মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে সেটা তখনো আমরা বুঝতে পারছিলাম না।
আমি আর ডোরা স্কুলের প্রাচীরে হেলান দিয়ে বসে রইলাম, কেমন যেন ঘোরের মাঝে বসে আছি, চারপাশে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। বেঁচে আছি না মরে গেছি, সেটাও যেন বুঝতে পারছি না। যুদ্ধটা কখন শেষ হয়েছে, আমরা সেটাও জানি না। একসময় শুনতে পেলাম মাসুদ ভাই চিৎকার করে ডাকছে, রঞ্জু, খোকন–ডোরা–