এটার মানে কী আমি বুঝলাম না, ডোরা মনে হয় বুঝল, সে মাথা নাড়ল। পাইকার ভাই বলল, রকীব মর্টারের এক্সপার্ট। শেলিং শুরু হলে তাকে বলে দিতে হবে, একবার লাইন রেঞ্জ ঠিক করে ফেললে আর চিন্তা নাই!
এই কথাটার মানেও আমি কিছু বুঝলাম না, কিন্তু ডোরা মনে হয় বুঝল, সে আবার মাথা নাড়ল। ঠিক তখন হুশ করে একটা শব্দ হলো আর তার কিছুক্ষণ পর দূরে কোথাও মর্টারের একটা শেল পড়ে একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো। পাইকার ভাই মাথা নিচু করে বলল, অ্যাটাক শুরু হয়ে গেছে।
মিলিটারি ক্যাম্পের ভেতর দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল, চিৎকার করে মিলিটারিগুলো কথা বলতে লাগল, একটু পরেই আমরা মেশিনগানের গুলি শুনলাম। মিলিটারিগুলো মেশিনগান দিয়ে গুলি শুরু করেছে।
আমাদের কেউ একজন বলল, লাইন ঠিক আছে, আরো বিশ গজ ভেতরে শেলিং করতে বলল। এবারে আমি বুঝতে পারলাম, মর্টারটা ঠিক দিকেই আছে, গোলাটা আরেকটু ভেতরে ফেলতে হবে।
কিছুক্ষণের ভেতরে আবার হুশ করে শব্দ হলো, তারপর একটা শেল পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো। আমরা দেখলাম এবারে শেলটা মিলিটারি ক্যাম্পের খুব কাছে পড়েছে। কেউ একজন চিৎকার করে বলল, আরো দশ গজ!
আবার হুশ শব্দ করে একটা শেল পড়ল। এবারে ঠিক ক্যাম্পের ভেতরে! প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে সাথে মিলিটারিদের চিৎকার শুনতে পেলাম। এবারে ভেতর থেকে মিলিটারিগুলো টানা গুলি করতে শুরু করল।
পাইকার ভাই খুবই শান্তভাবে সিগারেটের আগুনটা ঢেকে সেটাতে একটা লম্বা টান দিয়ে বললেন, ফার্স্ট ক্লাস!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কখন গুলি করব?
এখন না। অনেক পরে। আগে কিছু শেলিং হোক।
মর্টার থেকে শেল পড়তে লাগল। একটা-দুইটা বাইরে পড়ল কিন্তু বেশির ভাগ ক্যাম্পের ভেতরে।
মুক্তিযোদ্ধাদের দলটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক ভাগ স্কুলের গেটের সামনে। এক ভাগ পাশে। অন্য ভাগ রয়েছে ছোটাছুটি করার জন্য। পাইকার ভাই বলল, সারা রাত যুদ্ধ হবে, কালকে সারা দিন ধরেও হতে পারে, গুলি শেষ হয়ে গেলে গুলি পৌঁছে দিতে হবে, খিদে লাগলে খাবার এনে দিতে হবে, তাই একটা দলকে ছোটাছুটি করার জন্য রাখা হয়েছে।
পাইকার ভাইয়ের সাথে আমরা এক পাশে পজিশন নিয়েছি। আমাদের এখন কিছু করা নিষেধ, পাকিস্তানিদের বুঝতে দেয়া হবে না আমরা এখানে পজিশন নিয়েছি। স্কুলের প্রাচীর এদিকে ভাঙা, ভেতরে ঢোকার একটা সুযোগ আছে। স্কুলের গেটের সামনে যে দলটি আছে তারা গোলাগুলি শুরু করবে।
পাইকার ভাই খুব মনোযোগ দিয়ে শেলিংয়ের শব্দ শুনল, পাকিস্তানিদের গুলির শব্দ শুনল, মাঝে মাঝে তাকে খুব খুশি হতে দেখা গেল, পাইকার ভাই কীভাবে কীভাবে জানি বুঝে ফেলতে পারে কয়টা মিলিটারি ঘায়েল হয়েছে।
একসময় শেলিংয়ের শব্দ থেমে গেল আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে শুরু করল। প্রচণ্ড গুলির শব্দের সাথে সাথে তারা জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে, আমারও চিৎকার করার ইচ্ছা করছে কিন্তু আমাদের কোনো রকম শব্দ করা নিষেধ, তাই নিঃশব্দে মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। গোলাগুলির শব্দ বেড়ে যায়, আবার কমে আসে, আবার বাড়তে থাকে। মর্টার থেকে আবার শেলিং শুরু হয়ে যায়। এবারে আগেরটার সাথে তিন ইঞ্চি মর্টারটাও শেলিং শুরু করেছে। আমাদের স্কুলটাকে মনে হয় একেবারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলবে–একদিক দিয়ে ভালোই হবে, যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন আর লেখাপড়া করতে হবে না।
একসময় আমাদেরও গুলি করার সিগন্যাল দেয়া হলো, তখন আমরাও গুলি শুরু করলাম। স্কুলের ভেতরে একটা হইচই শুরু হয়ে গেল। বোঝা গেল, আমাদের ঠেকানোর জন্য কিছু মিলিটারি এই পাশে চলে আসতে শুরু করেছে। পাইকার ভাই তার এলএমজি দিয়ে টানা গুলি করে যেতে লাগলেন–প্রচণ্ড শব্দ, গুলির খোসা ছিটকে ছিটকে বের হচ্ছে, বারুদের গন্ধ, ব্যারেলটা দেখতে দেখতে আগুনের মতো গরম হয়ে যায়।
পাইকার ভাই বলেছিল সারা রাত যুদ্ধ হবে, তখন তার কথা আমি বিশ্বাস করিনি কিন্তু সত্যি একসময় চারদিক ফর্সা হতে শুরু করল, আমরা আশপাশে দেখতে শুরু করলাম। স্কুলের বিল্ডিংটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠল, এমনকি মাঝে মাঝে একটা-দুইটা পাকিস্তানি মিলিটারিকেও ভেতরে ছুটে যেতে দেখলাম, পাইকার ভাই একটাকে গুলি করে ফেলেও দিল!
পাকিস্তানি মিলিটারিগুলো কুৎসিত ভাষায় আমাদের গালাগাল করতে লাগল, সেই গালাগালও আমরা শুনতে পেলাম। পাইকার ভাইও চিৎকার করে পাল্টা গালাগাল দিল, তারপর আমাকে আর ডোরাকে বলল, তোমরা আণ্ডা-বাচ্চারা আমার কাছে আছ তাই তৃপ্তি করে হারামজাদাগুলিকে গালি দিতে পারছি না!
আমি বললাম, আপনি গালি দেন পাইকার ভাই, কোনো সমস্যা নাই।
ডোরা বলল, হ্যাঁ, গালি দেন! আচ্ছা মতন গালি দেন।
পাইকার ভাই ডোরার মাথায় হাত দিয়ে তার ছোট ছোট এলোমেলো চুলগুলো আরো এলোমলো করে দিয়ে বলল, নাহ্! খোকন এখানে আছে–একজন ভদ্রমহিলা! তার সামনে খারাপ গালি দেব নাকি? ছি! তার চাইতে হারামজাদাদের গুলি করি! কথা শেষ করে পাইকার ভাই তার এলএমজি দিয়ে টানা গুলি করে যেতে লাগল। গুলির খোসা ছিটকে ছিটকে বের হতে লাগল। পাইকার ভাইয়ের মুখ পাথরের মতো শক্ত, দেখে মনে হয় প্রত্যেকটা গুলি যেন এলএমজির ব্যারেল থেকে নয়– তার চোখের ভেতর থেকে বের হচ্ছে।