মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এইটা কিন্তু হিট অ্যান্ড রান। এটা হচ্ছে হিট অ্যান্ড ক্যাপচার। আমাদের ক্যাম্পটা দখল করতে হবে। বুঝেছ?
পাইকার ভাই আর আশপাশে যারা আছে, সবাই মাথা নাড়ল। মাসুদ ভাই বলল, সে জন্য এবারে অনেক বেশি রেডি হতে হবে। প্রথমবার কিছু ভারী অস্ত্র ব্যবহার করব।
একজন বলল, রেকি শুরু করে দিতে হবে।
হ্যাঁ, কাল থেকে রেকি শুরু করে দেব। আমি এই স্কুলটাতে মাস্টারি করেছি, তাই স্কুলটা কী রকম, ভালো করে জানি। এইটা একটা সুবিধা।
আমি বললাম, আমিও এই স্কুলটার ছাত্র। আমিও জানি।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বলল, রঞ্জু আরো ভালো করে জানে। মিলিটারি ক্যাম্প হওয়ার পরে আমরা কেউ ভেতরে যাই নাই, রঞ্জু গিয়েছে।
আমার হঠাৎ করে সেই সময়টার কথা মনে পড়ে গেল, হাত দুটি একটা টেবিলের পায়ার সাথে বেঁধে আমাকে মারছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করছি আর চিৎকার করছি আর চিৎকার করছি সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়তেই আমি কেমন জানি শিউরে উঠলাম।
পরদিন থেকে রেকি শুরু হয়ে গেল। দুইজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাঠানো হলো জেলে সাজিয়ে। হাতে জাল, কোমরে মাছ রাখার টুকরি, মাথায় গামছা। কালী গাংয়ে মাছ ধরে স্কুলের পাশ দিয়ে ঘুরে আসবে। তারা সারা দিন রেকি করে গভীর রাত্রে ফিরে এল। পরের দিন আরো দুইজনকে পাঠানো হলো সবজিওয়ালা সাজিয়ে। তারাও ফিরে এল প্রায় ভোররাতের দিকে। মাসুদ ভাই তাদের সাথে সবাইকে নিয়ে কথা বলল। কীভাবে কী করা হবে, সেগুলো ঠিক করা হলো। পরের দিন সবাই বিশ্রাম নিল। এর পরের দিন ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে। শুধু আক্রমণ না, দখল করে নেয়া হবে। কত দিন আগে হলেও মিলিটারির এ রকম একটা ক্যাম্প দখল করার কথা কেউ এত সহজে চিন্তাও করতে পারত না। কিন্তু দেখতে দেখতে সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। মিলিটারিরা এখন ভয়ে ভয়ে থাকে, তাদের মনের জোর বালে কিছু নেই। মাসুদ ভাই সব সময় বলে, যুদ্ধ আসলে অস্ত্র দিয়ে হয় না, যুদ্ধ হয় মনের জোর দিয়ে। আমাদের মতো মনের জোর এখন আর কারো নাই।
আমাদের বাহিনী বিশাল। সবাই মিলে রওনা দেওয়ার আগে ভারী ভারী অস্ত্রগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হলো। এগুলো কালী গাংয়ে নৌকা করে কাঁকনডুবি গ্রামে চলে যাবে। এই জঙ্গলে অপরিচিত গ্রামের মানুষ আসতে থাকল এবং যেতে থাকল। তারা মাসুদ ভাই আর অন্যদের সাথে কথা বলতে লাগল। আমরা তাদের কথাবার্তা থেকে ভাসা ভাসা বুঝতে পারলাম যে কাঁকনডুবিতে আমরা কোথায় উঠব, কী খাব–সেই সব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমার অবশ্যি চিন্তার কিছু নাই, নানিকে এত দিন পর দেখতে পাব সেটা চিন্তা করেই আমার আর সময় কাটছে না। মাসুদ ভাইয়েরা আমাকে এখন নানির সাথে দেখা করতে দেবে কি না, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন।
আমরা রওনা দিলাম খুব ভোরে। রওনা দেবার আগে মাসুদ ভাই সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা বক্তৃতা দিল। কঠিন কঠিন শব্দ দিয়ে বক্তৃতা– সবাই সবকিছু বুঝল বলে মনে হলো না। শুধু জয় বাংলা শ্লোগানটা আমরা সবাই বুঝতে পারলাম আমরাও তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম, জয় বাংলা!
সারা দিন ধরে আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলাম। কাঁকনডুবি গ্রামে যখন পৌঁছেছি তখনো সূর্য ডোবেনি। আমরা তাই জঙ্গল থেকে বের হলাম না। আমি গাছের ফাঁক দিয়ে কাঁকনডুবি গ্রামের দিকে তাকিয়ে রইলাম, দূরে হিন্দুপাড়া সড়ক ধরে সোজা গিয়ে বাম দিকে গেলে আমার বাড়ি, আরো সামনে গেলে কালী গাং। বাম দিকে মাইল খানেক গেলে আমাদের নবকুমার হাইস্কুল, যেটার নাম এখন গাঁজালা ইয়াকুব হাইস্কুল! ক্যাম্পটা দখল করে প্রথমেই আমাদের স্কুলের নামটা ঠিক করতে হবে। গাঁজালা ইয়াকুব–কী কুৎসিত একটা নাম!
মাসুদ ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে একটা আলোচনা করে যেতে লাগল। সবাই মিলে কিছু একটা ঠিক করে, কিছুক্ষণ আলাপ করে, নিজেরা নিজেদের ভেতর তর্ক করে, তারপর আবার অন্য একটা জিনিস ঠিক করে। শেষ পর্যন্ত মনে হয় তারা মোটামুটি ঠিক করতে পারল, ঠিক কীভাবে কী করা হবে।
তখন সবাই গাছে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে রাত গম্ভীর হওয়ার জন্য। আমি আর ডোরা পাইকার ভাইয়ের দুই পাশে বসে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম ভয়ংকর একটা যুদ্ধ হচ্ছে, বৃষ্টির মতো গুলি হচ্ছে, তার মাঝে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার নানি চিৎকার করে বলছে, শুয়ে পড় রঞ্জু, শুয়ে পড়! শুয়ে পড়।
আমি তবু দাঁড়িয়েই আছি!
.
২৪.
পাইকার ভাই ঘুরে বসে হাত দিয়ে আড়াল করে খুব সাবধানে তাঁর সিগারেটটা জ্বালাল, পাকিস্তানি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে যদি ম্যাচের আগুন দেখে ফেলে তারা বুঝে ফেলতে পারে আমরা এখানে আছি। পাইকার ভাই তার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, শীতের রাত্রে শরীর গরম করার জন্য সিগারেটের উপরে জিনিস নাই!
আমি আর ডোরা আবছা অন্ধকারে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, আমরা দুইজন শীতে কাঁপছি, সেটা যেন তার নজরেই পড়ছে না। আমি দুই হাত ঘষে একটু গৰ্ম করার চেষ্টা করে বললাম, পাইকার ভাই, কখন যুদ্ধ শুরু হবে?
সবাই পজিশন নেবার পর মনে হয় শেলিং শুরু করবে।
শেল আমাদের উপরে পড়বে না তো?
পাইকার ভাই হাসল, বলল, পড়ার কথা না। মর্টার পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে শুরু করে আস্তে আস্তে কমাবে।