মায়েরও একটা স্টেনগান আছে। স্টেনগানটা পাশে রেখে মা রান্না করে। যখন সবার পাতে খাবার তুলে দেয় তখন মায়ের ঘাড়ে একটা স্টেনগান থাকে! দেখতে খুবই মজা লাগে। যারা খায় তাদের হাতের কাছেও একটা রাইফেল না হয় এসএলআর থাকে। সব সময়েই একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।
মিলিটারির সাথে সামনাসামনি যুদ্ধে জলীল ভাই মারা গিয়েছে, তাকে খালের পাড়ে কবর দেওয়া হয়েছে। আহত হয়েছে দুইজন। একজন বেশি একজন কম যে বেশি আহত হয়েছে তাকে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা বর্ডার পার করিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সত্যি সত্যি হাসপাতালে নিয়ে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, আমরা জানি না। যে কম আহত হয়েছে সে ক্যাম্পেই আছে। তার বাম হাতের একটা আঙুল উড়ে গেছে, সে সময় পেলেই অবাক হয়ে তার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয় তার যে একটা আঙুল কম, সেটা সে এখনো মেনে নিতে পারছে না। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার কি আঙুলে খুব ব্যথা করে?
না। ব্যথা খুব বেশি নাই। কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমার যে আঙুলটা নাই মাঝে মাঝে সেই আঙুলটা চুলকায়।
শুনে আমি আর ডোরা প্রায় হেসেই ফেলছিলাম কিন্তু সে একটুও হাসল না। বলল, আমি মিছা কথা বলছি না। সত্যি কথা বলছি।
তখন আমরা অবাক হয়ে গেলাম, যেটা নাই সেটা কেমন করে চুলকাতে পারে?
.
খুব শীত পড়েছে, তাই আমরা আগুন জ্বালিয়ে সেটা ঘিরে বসে হাত-পা গরম করছি। আমি আর ডোরা পাইকার ভাইয়ের দুই দিকে বসে তার গল্প শুনছি। পাইকার ভাই খুব মজা করে গল্প করতে পারে, হাত-পা নেড়ে বলল, বুঝলি আস্তা-বাচ্চা, একবার একটা পাকিস্তান মিলিটারির ক্যাম্প আক্রমণ করেছি। হঠাৎ একটা পাকিস্তানি মিলিটারি একটা চায়নিজ রাইফেল নিয়ে বের হয়ে এসেছে। আমি তখন আমার স্টেনগান দিয়ে তার মাথায় গুলি করলাম। ফটাস করে একটা শব্দ হলো আর মাথার খুলিটা উড়ে গেল। তারপর কী হলো বল দেখি?
ডোরা মুখ বিকৃত করে বলল, মগজটা বের হয়ে এল?
পাইকার ভাই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, না না–পাকিস্তানিদের মাথায় কোনো ঘিলু নাই! খুলিটা যখন উড়ে গেল তখন দেখি সেখানে কিছু নাই।
ডোরা বলল, যাহ।
হ্যাঁ। মিলিটারিটা তখনো তার রাইফেল নিয়ে ছুটে আসছে আমার কাছে এসে বলল, খামোশ।
মাথা ছাড়া।
হ্যাঁ। মাথা ছাড়া।
ডোরা হি হি করে হেসে বলল, তুমি এত মিথ্যুক পাইকার ভাই।
পাইকার ভাই গম্ভীর মুখে বলল, আমি মোটেও মিথ্যুক না। সব সত্যি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তারপরে কী হলো?
মিলিটারিটা আমার কাছে এসে চায়নিজ রাইফেলটা আমার দিকে তাক করেছে তখন আমি কোনো উপায় না দেখে তার হাঁটুতে দিলাম একটা লাথি! তখন কী হলো বল দেখি?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো?
মিলিটারিটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল!
অজ্ঞান হয়ে?
হ্যাঁ। অজ্ঞান হয়ে। কেন বল দেখি?
আমি আর ডোরা জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
তার কারণ হচ্ছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের মগজ থাকে তাদের হাঁটুতে! বলে পাইকার ভাই নিজেই হা হা করে হাসতে থাকল। আমরাও হি হি করে হাসতে থাকলাম। ডোরা পাইকার ভাইকে কিল দিতে দিতে বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক! কত বড় মিথ্যুক!
পাইকার ভাই বলল, তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? মাঝে মাঝে দেখবে হাঁটতে হাঁটতে একটা পাকিস্তানি মিলিটারি দাঁড়িয়ে গেছে, তখন সামনেও যায় না। পেছনেও যায় না কেন বল দেখি?
কেন?
তখন তাদের ডান হাঁটু বলে সামনে যাও। বাম হাঁটু বলে পেছনে যাও– তখন সামনেও যেতে পারে না, পেছনেও যেতে পারে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।
ডোরা বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক!
পাইকার ভাই বলল, তখন কী করে জান?
কী করে?
তখন পেছন থেকে এসে একজন কষে তাকে একটা লাথি দেয় তখন সে আবার চলতে থাকে!
পাইকার ভাই আবার হি হি করে হাসতে লাগল আর তাকে দেখে আমরাও হাসতে লাগলাম। কাছেই মাসুদ ভাই বসে ছিল, মাসুদ ভাইও হাসতে হাসতে বলল, পাইকার! যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন তুমি পাকিস্তানি মিলিটারি কৌতুক নামে একটা বই বের করো অনেক বিক্রি হবে!
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল, বলল, দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন যে আমি কত কী করব, সেটা বলে শেষ করতে পারব না। প্রথম এক সপ্তাহ আমি স্টেডিয়াম, কার্জন হল, আর্টস বিল্ডিংয়ে হাঁটব আর যার সাথেই দেখা হবে তারেই বলব, জয় বাংলা! দৃশ্যটা কল্পনা করে পাইকার ভাইয়ের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল!
মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ পাইকার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, তাহলে স্বাধীনতার জন্য কাজ শুরু করে দেওয়া যাক, দেরি করে লাভ নাই।
পাইকার ভাই সোজা হয়ে বসে বলল, কী করতে হবে, কমান্ডার?
আমরা কাঁকনডুবি গ্রামের মিলিটারি ক্যাম্পটা দখল করে ফেলি।
আমি আর ডোরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুদ ভাই আমাদের চিৎকার করতে দিল, তারপর বলল, কয় দিনের ভেতরে মুক্তিবাহিনীর অনেক বড় আক্রমণ হবে। হেড কোয়ার্টার থেকে আমার কাছে খবর এসেছে এই ক্যাম্পটা নিউট্রালাইজ করে দিতে। বড় রাস্তাটা তাহলে ক্লিয়ার হয়।
পাইকার ভাইয়ের হাসিখুশি মুখটা একটু গম্ভীর হলো, বলল, কমান্ডার, এই অপারেশনটা কিন্তু অন্যটা অপারেশনের মতো না। এর আগে আমরা যেটা করেছি, সেটা হচ্ছে হিট অ্যান্ড রান। আমরা আক্রমণ করেছি তারপর সরে গেছি। সেই জন্য আমাদের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয় নাই।