মাসুদ ভাই সেদিকে ছুটে যেতে লাগল। আমাদের বুকটা ধক করে উঠল। ঠিক নাই মানে কী? গুলি খেয়ে আহত হয়েছে, নাকি কেউ মারা গিয়েছে?
আমি আর ডোরা মাসুদ ভাইয়ের পেছনে পেছনে ছুটে যাচ্ছিলাম কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে থামাল। সে ঠোঁট কামড়ে আছে আর চোখ থেকে পানি পড়ছে, আমাদেরকে বলল, তোমরা যেয়ো না।
কেন?
দৃশ্যটা ভালো না।
কে?
জলীল। আমি আর ডোরা একসাথে চিৎকার করে উঠলাম, জলীল ভাই?
হ্যাঁ।
আমরা একটু আগে একটা ট্রেঞ্চে বসেছিলাম। জলীল ভাই আমাদেরকে জোর করে দেশ-বিদেশের কথা বলছিল, আমরা অধৈর্য হয়ে যচ্ছিলাম। আমি কি জানতাম জলীল ভাই আর কোনো দিন জ্ঞানের কথা বলে আমাদের অধৈর্য করে দেবে না? আমার কেমন জানি দুর্বল লাগতে থাকে।
আমি আর ডোরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম সবাই মিলে কিছু একটা করছে। জলীল ভাইয়ের শরীরটাকে কাপড়ে ঢেকে সরিয়ে আনতে থাকে।
ডোরা বলল, আয়, ওদিকে যাই।
কোন দিকে?
একটু আগে যেখানে পাকিস্তানি মিলিটারি ছিল ডোরা হাত দিয়ে সেই দিকটা দেখাল। আমি বললাম, চল।
আমি আর ডোরা এগিয়ে গেলাম। মাটিতে অসংখ্য গুলির খোসা বারুদের গন্ধ। মাটিতে রক্ত। বুটের ছাপ। একটু আগেই এখানে কী ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছিল, এখন কিছু নেই। কী আশ্চর্য।
ডোরা হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ স স স।
আমি ফিসফিস করে বললাম, কী হয়েছে?
শোন।
আমি কান পেতে শুনলাম। অস্পষ্টভাবে একজন মানুষের গোঙানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরা এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কোথাও কেউ নেই কিন্তু চাপা গোঙানোর শব্দটা এখনো আসছে। মাঝে মাঝে থেমে যায় তারপর আবার শুরু হয়। আমরা স্টেনগান হাতে নিয়ে শব্দটা লক্ষ করে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা ঝোঁপের আড়ালে একজন মানুষ চিত হয়ে পড়ে আছে, পায়ে গুলি লেগেছে, রক্তে সাদা পাজামা ভেসে যাচ্ছে। আমরা আরেকটু এগোতেই মানুষটা ঘোলা চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমরা তখন মানুষটাকে চিনতে পারলাম। এটা হচ্ছে সেই রাজাকার মানুষটি, যে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, যে পাকিস্তান মিলিটারিগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল।
আমি আর ডোরা মানুষটার দিকে স্টেনগানটা তাক করে রাখলাম, মানুষটা আমাদের দিকে ঘোলা চোখে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত একটা দৃষ্টি!
ডোরা বলল, আপনি রাজাকার?
মানুষটা কোনো কথা বলল না। ডোরা আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন রাজাকার হলেন?
মানুষটা এবারেও কিছু বলল না, ডোরা আবার জিজ্ঞেস করল, মানুষ কেমন করে রাজাকার হয় বলবেন?
মানুষটা বিড়বিড় করে বলল, আমারে মাইরা না। আল্লাহর কসম।
কী আশ্চর্য! মানুষটা ভাবছে আমরা তাকে গুলি করব। একটু আগে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার জন্য সে মিলিটারিদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছিল, এখন সে আমাদের কাছে জান ভিক্ষা চাচ্ছে। আমি ডোরাকে বললাম, ডোরা। তুই এখানে থাক, আমি মাসুদ ভাইকে ডেকে আনি।
ডোরা মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে কোলের ওপর তার স্টেনগানটা রেখে বলল, যা।
মাসুদ ভাইয়ের সাথে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা এল, একজন তার রাইফেলটা রাজাকারের মাথার দিকে তাক করে হিংস্র গলায় বলল, শুয়রের বাচ্চা তোর জন্য তোর জন্য– তারপর তার শরীরে অনেক জোরে একটা লাথি দিল, লাথি খেয়ে রাজাকারটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে।
মাসুদ ভাই ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুমি শান্ত হও তো–
কেন শান্ত হব? কেন? এই শুয়রের বাচ্চার জন্য জলীল ভাই- মানুষটা কথা শেষ করতে পারল না, হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
দুইজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে টেনে সরিয়ে নিল। মাসুদ ভাই রাজাকারটার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি রাজাকার?
মানুষটা কোনো কথা বলল না, শুধু তার ঠোঁট দুটি নড়তে লাগল। মাসুদ ভাই বললেন, তুমি কি দেখেছ পাকিস্তান মিলিটারি যারা মরেছে, যারা গুলি খেয়েছে, আহত হয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে গেছে। তোমাকে নেয় নাই?
রাজাকারটা কোনো কথা বলল না। ফ্যাকাশে মুখে মাসুদ ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাসুদ ভাই বলল, নিজের দেশের সাথে বেইমানি করে তুমি কী পেলে? তুমি যে পাকিস্তানি মিলিটারির পা চাটো সেই মিলিটারিরাও তোমাকে বেইমান জানে। তোমাকে বিশ্বাসঘাতক জানে। সে জন্য তারাও তোমাকে ফেলে গেছে।
মানুষটা কোনো কথা বলল না, দর দর করে ঘামতে লাগল। মাসুদ ভাই বলল, বলো, তুমি কী করো? মুসলিম লীগ, না জামাতে ইসলামী?
মানুষটা এমনভাবে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে কোনো কথা বুঝতে পারল না। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমি একে চিনি। এর নাম কাদের। এ জামাতে ইসলামী। পি কে কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি।
মাসুদ ভাই উঠে দাঁড়াল, আমার আর ডোরার দিকে তাকিয়ে বলল, রঞ্জু, খোকন, তোমরা যাও।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন মাসুদ ভাই?
মাসুদ ভাই কঠোর মুখে বলল, প্রশ্ন করো না। যাও।
আমরা তখন সরে গেলাম। জঙ্গলের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ডোরা জিজ্ঞেস করল, রাজাকারটাকে মনে হয় মেরে ফেলবে, তাই না?
আমি বললাম, মনে হয়।
.
২৩.
আমরা আবার আমাদের ক্যাম্পে ফিরে এসেছি, কিন্তু এখন এটা আগের মতো না। আগে এটা ছিল আমাদের ঘাঁটি, কিন্তু এখন এটা আমাদের ঘাঁটি না। এখন এখানে আছি অল্প সময়ের জন্য। আমরা এখান থেকে যেকোনো সময় চলে যাব। সবাই এখন নিজের কাছে তার অস্ত্র রাখে। আমি মাথার কাছে স্টেনগান নিয়ে ঘুমাই। আমার মাথার নিচে গ্রেনেড থাকে। কেউ যদি কয়েক দিন আগেও আমাকে বলত আমার নিজের একটা স্টেনগান থাকবে, গুলি থাকবে, গ্রেনেড থাকবে, তাহলে সেটা আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম না।