ট্রেঞ্চের ভেতরে আমরা চুপচাপ অপেক্ষা করছি। মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে বাইরে দেখছি। এখান থেকে দূরে মাটির সড়কটা আবছাভাবে দেখা যায়। মিলিটারিগুলো সেই সড়কে হাজির হওয়ার পরই যুদ্ধ শুরু হবে, তার আগে কারো কিছু করার নেই। অন্যেরা শুধু অপেক্ষা করবে। আমার আর ডোরার কপাল খারাপ, অপেক্ষা করার সময় আমাদের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধার গভীর জ্ঞানের কথা শুনতে হবে।
ডোরা একটু পরে পরে মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছিল–একবার উঁকি দিয়ে মাথাটা ভেতরে ঢোকানোর আগে কী মনে করে উল্টো দিকে তাকাল তারপর ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। আমিও মাথা বের করলাম, দেখলাম খালের তীর ধরে মিলিটারিদের বিশাল একটা বাহিনী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। তারা মোটেও সড়ক ধরে এসে খালটা পার হচ্ছে না। উত্তর দিকে কোনো একটা জায়গায় খালটা আগে পার হয়ে নিয়েছে, এখন আমাদের দিকে আসছে! ওরা মোটেও সামনে দিয়ে আক্রমণ করবে না, ওরা আক্রমণ করবে পেছন দিক দিয়ে। সর্বনাশ!
আমি ডোরার দিকে তাকালাম, ডোরা আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, এখন কী হবে?
ডোরা বলল, মাসুদ ভাইদের জানাতে হবে!
হ্যাঁ। বলে আমি আর ডোরা লাফ দিয়ে ট্রেঞ্চ থেকে বের হয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম। আমাদের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধা হতবাক হয়ে বলল, কী করো? কী করো?
ডোরা বলল, মিলিটারি চলে এসেছে! উল্টো দিক দিয়ে।
মিলিটারিগুলো যেন আমাদের দেখতে না পায় সেই ভাবে গাছের আড়ালে আড়ালে ছুটে আমি আর ডোরা মাসুদ ভাইয়ের ট্রেঞ্চটা বের করলাম, মাসুদ ভাই তার এলএমজিটার পেছনে বসে সিগারেট খাচ্ছিল, আমাদের দেখে আঁতকে উঠল, ধমক দিয়ে বলল, কী করছ তোমরা? বাইরে কেন?
আমি আর ডোরা একসাথে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, মিলিটারি!
মিলিটারি?
হ্যাঁ। আমি হড়বড় করে বললাম, খাল পার হয়ে গেছে, পেছন থেকে আসছে।
ডোরা বলল, এদিক দিয়ে আসবে না
মাসুদ ভাই হকচকিয়ে গেল, কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিল, দুই-এক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, জঙ্গলে ঢোকার আগে অ্যামবুশ করতে হবে। সবাই বের হও।
আমরা দেখলাম ট্রেঞ্চের ভেতর থেকে পিলপিল করে মুক্তিযোদ্ধারা বের হতে শুরু করল, তারপর গুঁড়ি মেরে মিলিটারিদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। আমি আর ডোরা তাদের পিছু পিছু যেতে লাগলাম। তোমরা ছোট, তোমরা পেছনে থাকো, এ রকম কথা বলার মতো অবস্থা কারো নেই।
কয়েক সেকেন্ডে যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনাটা পাল্টে দিতে হলো। মুক্তিযোদ্ধারা ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আমি আর ডোরা একটা বড় গাছের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। এখান থেকে মিলিটারি দলটাকে দেখা যাচ্ছে। দলের সামনে একটা বাঙালি চেহারার মানুষ। সে পথ দেখিয়ে আনছে, কাছাকাছি পৌঁছানোর পর মানুষটাকে আমি চিনতে পারলাম। এই মানুষটা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পের সেই রাজাকার! মানুষ কেমন করে রাজাকার হয়?
মিলিটারিগুলো মোটামুটি একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছাতেই মাসুদ ভাইয়ের এলএমজি গর্জন করে উঠল। সাথে সাথে চারপাশের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র একসাথে গর্জন করে উঠল। আমি আর ডোরাও জীবনের প্রথমবার স্টেনগানের ট্রিগার টেনে ধরলাম, স্টেনগানটা আমাদের হাতে জীবন্ত প্রাণীর মতো কেঁপে কেঁপে উঠল, প্রচণ্ড গুলির শব্দে আমাদের কানে তালা লেগে গেল।
সামনে থাকা মিলিটারিগুলো কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে যেতে শুরু করল, অন্যগুলোও সাথে সাথে শুয়ে পড়েছে, কভার নেওয়ার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড গুলির জন্য কেউ মাথা তুলতে পারছে না–গড়িয়ে গড়িয়ে খালের দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছের আড়ালে থেকে গুলি করছে। একজন দাঁত দিয়ে পিন খুলে একটা গ্রেনেড ছুড়ে দিল। বিকট শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল।
আমি পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছিলাম না, গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দ, বারুদের গন্ধ, আর ধোয়ায় চারদিক আচ্ছন্ন হয়ে আছে। মিলিটারিরা গুলি করতে শুরু করেছে, আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। গাছের ডাল ভেঙে পড়ছে, গাছগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই তাহলে যুদ্ধ? যুদ্ধ তাহলে এ রকম? এই রকম যুদ্ধ করে আমাদের বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে? এই যুদ্ধে কেউ কি মারা যাবে? আমি কি মারা যাব? কিন্তু আমার ভেতরে কোনো ভয় নেই, কোনো আতঙ্ক নেই। মনে হতে থাকে বেঁচে থাকা মরে থাকায় কিছু আসে যায় না। মনে হতে থাকে আকাশ-বাতাস, গাছপালা, মাটি-নদী, চাঁদ-সূর্য কোথাও কিছু নেই। মনে হতে থাকে সারা পৃথিবীতে শুধু আমরা, শুধু আমাদের হাতে আছে অস্ত্র আর জীবন্ত প্রাণীর মতো সেই অস্ত্র কেঁপে কেঁপে উঠছে।
কতক্ষণ যুদ্ধ হয়েছে আমরা জানি না, আমরা কি যুদ্ধে জিতেছি, না হেরেছি, সেটাও জানি না, কিন্তু হঠাৎ দেখলাম গুলির শব্দ কমে এসেছে, দেখতে পেলাম মুক্তিবাহিনী জয় বাংলা চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে।
আমি আর ডোরাও জয় বাংলা’ জয় বাংলা’ চিৎকার করতে করতে ছুটে যেতে লাগলাম। মাসুদ ভাই আমাদের থামাল, বলল, ওদের পালিয়ে যেতে দাও। পালিয়ে যেতে দাও।
আমরা থামলাম। মাসুদ ভাই তখন ঘুরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, সবাই ঠিক আছে?
দূর থেকে একজন ভাঙা গলায় বলল, না কমান্ডার।