রাত্রি বেলা খাওয়ার আগে মাসুদ ভাই সবাইকে নিয়ে একটা মিটিং করল। একটা গুলির বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে মাসুদ ভাই বলল, আমরা এর আগে অনেক অপারেশন করেছি, মিলিটারির সাথে যুদ্ধ নূতন কিছু না। কিন্তু কালকের যুদ্ধটা অন্য রকম–এই প্রথমবার আমরা এক জায়গায় বসে থাকব আর মিলিটারি আমাদের সেই জায়গায় আক্রমণ করবে। আমরা আগে কখনো এই রকম যুদ্ধ করি নাই সত্যি কথা বলতে কী–আমি এই যুদ্ধ করতে চাই না। কাজেই কালকের যুদ্ধটা হবে শুধুমাত্র ঠেকিয়ে রাখা।
আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে আমাদের অস্ত্র। আমাদের গোলাগুলি। তাই সেগুলো আমাদের রক্ষা করতে হবে। কাল সবাইকে অস্ত্র ভাগাভাগি করে দেওয়া হবে–আমরা রঞ্জু-খোকনকেও একটা করে অস্ত্র দেব। মাকেও একটা অস্ত্র দেব।
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু আমি আর ডোরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম। মাসুদ ভাই বলল, বাকি অস্ত্র আমরা এখান থেকে সরিয়ে লুকিয়ে ফেলব। আমি মনে করি না পাকিস্তানি মিলিটারি এত দূর আসতে পারবে–তার পরও আমরা কোনো ঝুঁকি নিব না।
আমরা যে জঙ্গলে আছি সেখানে ঢুকতে হলে একটা খাল পার হতে হয়। আমরা সেই খালের ওপর তাদেরকে অ্যামবুশ করব। সেখানে ফাঁকা জায়গা, কভার নেয়ার জায়গা নাই। দুপুরের আগে তারা সেখানে পৌঁছাতে পারবে না, যদি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে পারি তাহলেই যথেষ্ট। রাত্রে তারা এখানে থাকবে না। এই জঙ্গলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে তারা জন্মেও আমাদেরকে খুঁজে পাবে না।
মাসুদ ভাই আরও অনেক কিছু বলল, উত্তেজনার জন্য আমি তার বেশির ভাগই শুনতে পাচ্ছিলাম না কাল আমাদেরও অস্ত্র দেবে–কী। সাংঘাতিক! কোন অস্ত্র দেবে? ইশ! যদি একটা স্টেনগান পেতাম কী মজা হতো! সাথে একশ রাউন্ড গুলি আর দুইটা গ্রেনেড!
উত্তেজনায় আমার চোখে ঘুম আসছিল না। শেষ পর্যন্ত যখন ঘুমিয়েছি তখন মনে হলো প্রায় সাথে সাথে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হয়েছে। তারপর একজন একজন করে সবাইকে অস্ত্র বুঝিয়ে দেওয়া শুরু হলো। আমি আর ডোরা সত্যি সত্যি একটা করে স্টেনগান পেয়েছি। সাথে একশ রাউন্ড করে গুলি আর দুইটা গ্রেনেড। আমরা নিজেদের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না। স্টেনগানের কালো শীতল নলে হাত বোলাতে গিয়ে আমার শরীরে কেমন জানি শিহরণ হতে থাকে।
অন্ধকার থাকতেই আমরা পুরো ক্যাম্প খালি করে বের হয়ে গেলাম। বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধা অবশ্যি রাত থাকতেই খালের পাড়ে গিয়ে পজিশন নিয়েছে। আমরা যখন খালের পাড়ে গিয়েছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম গিয়ে দেখব সবাই বিভিন্ন জায়গায় পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কী অবাক ব্যাপার কোথাও কেউ নেই! আমি যখন খোঁজাখুঁজি করছি তখন হঠাৎ একটা ঝোঁপ নড়ে উঠল আর তার ভেতর থেকে পাইকার ভাইয়ের মাথা বের হয়ে এল! পাইকার ভাই বলল, এই যে আণ্ডা আর বাচ্চা! দেখি অস্ত্র হাতে তোমাদের কেমন লাগে!
আমি আর ডোরা হাতের স্টেনগান উঁচু করে ধরতেই আশপাশে অনেকগুলো ঝোপ নড়ে উঠল, সেখান থেকে অনেকগুলো মাথা বের হয়ে এল এবং সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। আমাদের একই সাথে একটু লজ্জা লাগছে, আবার আনন্দে বুকটা ফেটেও যাচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে সুঝতে পারলাম অনেকগুলো ট্রেঞ্চ খোঁড়া হয়েছে, তার ভেতরে সবাই অপেক্ষা করছে। গাছের ডালপাতা ঝোঁপঝাড় দিয়ে তাদের ঢেকে দেয়া হয়েছে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, এখানে এতজন মুক্তিযোদ্ধা অপেক্ষা করছে। জঙ্গলের আরো ভেতরে আরো মুক্তিযোদ্ধাও লুকিয়ে আছে।
মাসুদ ভাই বলল, রঞ্জু আর খোকন! তোমরা পেছনে চলে যাও।
পেছনে? পেছনে কেন?
তোমরা ছোট, সে জন্য। তোমাদের যতদূর সম্ভব দূরে থাকতে হবে।
কাজেই আমি আর ডোরা মন খারাপ করে অনেক দূরে সরে গেলাম। যেখানে গেলাম সেই জায়গাটাও খালের কাছে কিন্তু রাস্তা থেকে অনেক দূরে। সেখানে একটা ট্রেঞ্চের ভেতরে ঢুকে গেলাম। উপরে গাছপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে, দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কেউ আছে। এই ট্রেঞ্চের ভেতরে আরো দুইজন মুক্তিযোদ্ধা আছে–একজন জলীল ভাই, তাকে নিয়ে পাইকার ভাই আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল, তার কারণ জলীল ভাই সব সময় জ্ঞানের কথা বলে, সবার কান ঝালাপালা করে দেয়। পাইকার ভাইয়ের কথা ভুল নয়। সত্যি সত্যি জলীল ভাই কিছুক্ষণের মাঝে আমাদেরকে জ্ঞান দিয়ে কথা বলতে লাগল, বুঝলে রঞ্জু আর খোকন, এই যুদ্ধে আমরা খুব বেকায়দায় আছি। পাকিস্তানের পক্ষে আছে আমেরিকা আর চীন। শুধু তা-ই না, সব মিডল ইস্টের দেশ। আমাদের সাথে খালি ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়ার সাথে রাশিয়া। ইন্ডিয়ার নিজেরই ঠিক নাই, আমাদের সাহায্য করবে কীভাবে? তার উপরে তাদের ঘাড়ে আছে এক কোটি শরণার্থী। তারা কি শরণার্থীদের খাওয়াবে, নাকি আমাদের সাহায্য করবে? তবে এই অবস্থায় একটা সুবিধা আছে। ইন্ডিয়া কত দিন এক কোটি মানুষকে খাওয়াবে? কাজেই বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের লাভ। তাই তাদের ইচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো… কিছুক্ষণের মাঝেই আমার আর ডোরার মাথা ধরে গেল।
যুদ্ধের পরিকল্পনাটা সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। মাটির সড়ক ধরে পাকিস্তান মিলিটারির দলটা খালের সামনে পৌঁছানোর পর যখন তারা খালটা পার হতে শুরু করবে তখন আক্রমণ শুরু করা হবে। সবাইকে একশবার করে বলে দেয়া হলো মাসুদ ভাই যখন তার এলএমজি দিয়ে গুলি শুরু করবে ঠিক তখন সবাইকে গুলি শুরু করতে হবে। তার আগে কেউ একটা গুলিও করতে পারবে না। মাসুদ ভাই সবাইকে বলে দিয়েছে কেউ যেন আগে গুলি না করে, যদি করা হয় তাহলে মিলিটারিকে অতর্কিতে আক্রমণ করার সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে। সব মুক্তিযোদ্ধা রাজি হয়েছে। প্রথম প্রথম এটা নিয়ে সমস্যা হতো, নার্ভাস হয়ে আগেই কেউ না কেউ গুলি করে দিত। এখন সমস্যা হয় না। ঠাণ্ডা মাথায় অপেক্ষা করে।