গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল আর আমি ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। সাথে সাথে আমার মনে পড়ল আমার রাজাকারটাকে চোখে চোখে রাখার কথা। আবছা অন্ধকারে তাকিয়ে দেখলাম মানুষটা তার বিছানায় নাই। আমি সাথে সাথে উঠে বসে চারদিকে তাকালাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি বাইরে আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো একজন নড়ছে। আমি চুপি চুপি বের হয়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম মানুষটা কী করছে। ঠিক বুঝতে পারলাম না, মনে হলো একটা কাপড় টানাটানি করে সেখানে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করছে।
আমি তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম, সাবধান! রাজাকার! রাজাকার!
মানুষটা ঝট করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তারপর হাতের সবকিছু নিচে ফেলে জঙ্গলের দিকে দৌড়াতে লাগল।
আমার চিৎকারে অনেকে ঘুম থেকে উঠে গেছে, কয়েকজন হাতে স্টেনগান নিয়ে ছুটে এসে বলল, কোথায়? কোথায় রাজাকার?
মানুষটা যেদিকে দৌড়ে গিয়েছে আমি হাত দিয়ে দেখালাম। ঠিক কী হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না, সবাই অন্ধকারে ছোটাছুটি করছে। ডোরাও উঠে এসেছে। একসময় মাসুদ ভাই বের হয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
আমি বললাম, মাসুদ ভাই, রাজাকার।
কোথায় রাজাকার? আমি তখন পকেট থেকে কাগজগুলো বের করে মাসুদ ভাইকে দিলাম, বললাম, এই দেখেন।
এগুলো কিসের কাগজ?
যে মানুষটা জঙ্গলে পালিয়ে গেছে তার নোটবইয়ে এগুলো লেখা ছিল।
তুমি কেমন করে পেলে?
আমি তখন সবকিছু খুলে বললাম, মাসুদ ভাই সবকিছু শুনে তখন তখনই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটা দলকে পাঠাল রাজাকারটাকে জঙ্গলের ভেতর থেকে ধরে আনতে।
ঘরের বাইরে কেরোসিনের বোতলটা পাওয়া গেল। বোতলের মুখে কাপড়ের সলতে লাগিয়ে সেখানে আগুন দিয়ে বোতলটাকে অস্ত্রের ঘরে ছুড়ে মারার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যেহেতু ভেতরে কেরোসিন নেই, অন্য কিছু আছে তাই কিছুতেই আগুন ধরাতে পারেনি। কেরোসিনের বদলে ভেতরে কী আছে, সেটা আমি পরিষ্কার করে না বললেও মাসুদ ভাই বোতলটা হাতে নিয়েই বুঝে গেলেন এবং সবাই তখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিল।
শুধু ডোরা বলল, ছিঃ! নোংরা খবিস কোথাকার!
রাজাকারটাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেল না।
ভোরবেলা নাস্তা করতে করতে মাসুদ ভাই বলল, এখন সবাই রেডি হও, যেকোনো দিন মিলিটারি আমাদের আক্রমণ করতে আসছে!
পাইকার ভাই বলল, ভালোই হলো। আগে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। এখন কোনো পরিশ্রম নাই। আমাদের যুদ্ধ করতে যেতে হবে না। যুদ্ধ আমাদের কাছে চলে আসছে!
মাসুদ ভাই হাসল, হেসে বলল, এই ভাবে দেখলে ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা হচ্ছি গেরিলা। গেরিলারা তিন রকম যুদ্ধ করে। রেইড মানে শক্রর ঘাঁটিতে ঝটিকা আক্রমণ, অ্যামবুশ মানে তারা যখন কোথাও যায় তখন লুকিয়ে তাদের আক্রমণ আর স্নাইপিং–অর্থাৎ দূর থেকে গুলি করা। গেরিলা যুদ্ধের কোনো কেতাবে লেখা নাই আমরা আরাম করে বসে বসে অপেক্ষা করব কোন সময় তারা আমাদের আক্রমণ করবে!
আমাদের এখানে আসা সোজা কথা না তাদেরকে এই পর্যন্ত আসতে দেব না, তার আগেই অ্যামবুশ করব।
মাসুদ ভাই মাথা চুলকাল, কিন্তু তারা আমাদের পজিশন জেনে গেছে দূর থেকে মর্টার দিয়ে শেলিং করে ছাতু বানিয়ে দেবে। প্লেন ডাকিয়ে এনে প্লেন থেকেও স্ট্রাফিং করতে পারে।
পাইকার ভাই একটা নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে আর ডোরাকে দেখিয়ে বলল, এই বাচ্চাগুলো যখন বলেছে খুবই জরুরি দরকার আমার সাথে দেখা করার, তখন যদি তাদের কথাকে গুরুত্ব দিতে তাহলে এই ঝামেলা হতো না! রাজাকারটা তাহলে এইভাবে পালাতে পারত না!
একজন মুক্তিযোদ্ধা অপরাধী মুখে বলল, আসলে বুঝতে পারি নাই। ভাবছি ছোট বাচ্চা তাদের আবার জরুরি কাজ আর কী হবে?
মাসুদ ভাই বলল, যাই হোক, যা হবার হয়েছে, এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই। আমরা এখন কী করব, সেটা ঠিক করা যাক।
খুব কম কথা বলে সেই রকম একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আসলে আমাদের এখন এই ক্যাম্পটা গুটিয়ে আশপাশের গ্রামে চলে যাওয়া উচিত। একটা একটা গ্রাম মুক্ত করে মুক্তাঞ্চল তৈরী করার সময় হয়েছে।
মাসুদ ভাই বলল, ঠিকই বলেছ। আমাদের এখন লুকিয়ে থাকার সময় শেষ– এখন পাকিস্তানিদের লুকিয়ে থাকার সময় শুরু।।
তখন মাসুদ ভাই অন্য সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কীভাবে কী করা যায়, সেটা নিয়ে আলাপ করতে লাগল। প্রথম দিকে আলাপটা সহজ ছিল, আমরা সেটা বসে বসে শুনলাম, আস্তে আস্তে আলাপটা জটিল হয়ে গেল, তখন আমি আর ডোরা উঠে গেলাম।
আমি ডোরাকে বললাম, একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে।
কী ভালো হয়েছে?
আমরা এত দিন থেকে বলছি আমাদেরকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে, আমাদের নিয়ে যায় নাই! এখন যখন যুদ্ধটা এখানেই হবে, এখন তো আমরা যুদ্ধটা দেখতে পারব!
খালি দেখব না, যুদ্ধ করব। ডোরা মুখ শক্ত করে বলল, করবই করব।
মুক্তিবাহিনী যখন আক্রমণ করে তখন তারা হঠাৎ করে গোপনে আক্রমণ করতে পারে। যদি অবস্থা ভালো থাকে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, অবস্থা একটু খারাপ হলেই সরে পড়তে পারে। পাকিস্তান মিলিটারির সেই সুবিধা নাই, তাদের আক্রমণ করতে হলে অনেক লটবহর নিয়ে আক্রমণ করতে হয়–তারা কবে কখন কোন দিকে যাচ্ছে, সেই খবর অনেক আগেই পৌঁছে যায়। তাই যেদিন পাকিস্তানি মিলিটারি আমাদের ক্যাম্প আক্রমণ করতে আসবে আমরা একদিন আগেই তার খবর পেয়ে গেলাম।