আমি রঞ্জু।
তুমি কী চাও।
কিছু চাই না।
তাহলে?
তাহলে কী?
মানুষটা আমার কথায় খুবই বিরক্ত হলো। বলল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, এমনি। ছোট হওয়ায় অনেক সুবিধা। কিছু বুঝি না, কিছু জানি না, হাবাগোবা মানুষের মতো ভান করে থাকা যায়। তাই আমি হাবাগোবা ধরনের মানুষ, এ রকম ভান করে দাঁড়িয়েই থাকলাম। মানুষটা তখন খেঁকিয়ে উঠে বলল, যাও! যাও এখান থেকে।
আমি বললাম, আচ্ছা। তারপর হেঁটে হেঁটে চরমপত্র শুনতে চলে এলাম। ডোরা জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি?
ঐ তো।
ডোরা বিরক্ত হয়ে বলল, ঐ তো মানে আবার কী?
আমি গলা নামিয়ে বললাম, মনে হয় এইখানে একজন রাজাকার ঢুকেছে।
রাজাকার।
হ্যাঁ।
ডোরা ফিসফিস করে বলল, তুই কেমন করে বুঝতে পারলি?
এখনো পুরাপুরি বুঝতে পারি নাই। চরমপত্রটা শেষ হোক, তারপরে বলব।
ডোরা শোনার জন্য অধৈর্য হয়ে গেল। তাই তাকে নিয়ে এক কোনায় গিয়ে যা কিছু বললাম শুনে ডোরাও খুব উত্তেজিত হয়ে গেল। বলল, চল, রাজাকারকে গিয়ে ধরি। গুলি করে দিই।
আমি মাথা চুলকে বললাম, এখনো তো প্রমাণ হয় নাই সে রাজাকার। যদি রাজাকার না হয়?
তাহলে?
আগে দেখি মানুষটা কী করে।
কীভাবে দেখবি?
আমি আবার মাথা চুলকালাম, বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয়?
কী কাজ?
খাওয়ার সময় তুই মানুষটাকে ব্যস্ত রাখবি, আমি তখন তার বিছানাপত্র জামাকাপড় খুঁজে দেখব কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় কি না।
ডোরা বলল, ঠিক আছে।
কাজেই খেতে বসে আমি খুব তাড়াতাড়ি গপগপ করে খেয়ে শেষ করে উঠে গেলাম। ডোরা মানুষটার পাশে বসে থাকল, মানুষটা যখন আধাআধি খেয়েছে তখন ধাক্কা মেরে তার খাবারের থালাটা ফেলে দিল। ইচ্ছে করে থালাটা ফেলেনি–হঠাৎ করে ধাক্কা লেগে পড়ে গেছে, এই সব বিষয় নিয়ে কথা বলে আবার নূতন করে তাকে খাবার দেয়া হলো।
আমি ততক্ষণে তার বিছানার নিচ থেকে একটা রুলটানা খাতা বের করেছি, প্রথম দিককার পৃষ্ঠাতে অনেক কিছু লেখা, আবছা অন্ধকারে পড়ার কোনো উপায় নেই। আমি বেশি ঝামেলায় না গিয়ে খাতার পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নিলাম। খাতার সাথে একটা বলপয়েন্ট কলমও ছিল। আমি কলম দিয়ে সাদা পৃষ্ঠাতে হিজিবিজি লিখে ভরে ফেললাম। খাতাটা খুলে পরীক্ষা করলেও অন্ধকারে বুঝতে পারবে না যে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে নিয়েছি। খোঁজাখুঁজি করে আমি একটা বোতল পেলাম, বোতলের ছিপি খুলে গন্ধ নিতেই বুঝতে পারলাম ভেতরে কেরোসিন। আমাদের ক্যাম্পে কেরোসিন খুব হিসাব করে খরচ করতে হয়। তার মাঝে এতোটা কেরোসিন এই মানুষটা সরিয়ে নিল কেমন করে? তার চাইতে বড় কথা কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালায়, এই কেরোসিন দিয়ে সে কোথায় আগুন জ্বালাবে? কেন জ্বালাবে?
আমার চিন্তা করার বেশি সময় নাই। তাই কেরোসিনের বোতলটা নিয়ে বের হয়ে গেলাম ব্যারাকের পেছনে। একটা ভাঙা মাটির হাড়ি পড়েছিল, সেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। আমি পানিটা ফেলে সেখানে কেরোসিনটা ঢেলে রাখলাম। এখন বোতলটাতে কোনো রকম তরল ভরে রাখতে হবে। সেটা অবশ্যি সমস্যা হলো না, ভীষণ বাথরুম পেয়েছিল, কাজটা বাইরে না করে বোতলের ভেতরে করে ফেললাম–এক ধাক্কায় দুটো কাজ হয়ে গেল।
ততক্ষণে খাওয়া শেষের দিকে, আমি ডোরার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলাম কাজ শেষ। ডোরাও তখন মানুষটার সামনে থেকে সরে এল।
ক্যাম্পের পেছনে বড় বড় মাটির চুলোয় তখনো গনগনে কয়লার লালচে একটা আলো রয়েছে, সেই আলোতে আমরা মানুষটার কাগজে কী লেখা আছে পড়ার চেষ্টা করলাম। সেখানে লেখা :
রাইফেল প্রায় ত্রিশটা
এসএলআর প্রায় ১৫টা
এনারগা আনুমানিক ১০টা
এলএমজি চারটা
স্পেয়ার ব্যারেল চারটা
স্পেয়ার ম্যাগাজিন চার-পাঁচটা
দুই ইঞ্চি মর্টার সাতটা
তিন ইঞ্চি মর্টার একটা
গ্রেনেড একশোর বেশি
গুলি আনুমানিক দশ হাজার রাউন্ড
অন্য একটা কাগজে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, তার পাশে কে কোন গ্রামের, বাবার নাম কী এবং তার পাশে কোথাও লেখা আওয়ামী লীগ, কোথাও ন্যাপ, কোথাও হিন্দু লেখা!
পড়ে আমাদের কোনো সন্দেহই থাকল না, মানুষটা নিশ্চয়ই রাজাকার। তা না হলে অস্ত্রপাতির তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম-ঠিকানা কাগজে লিখেছে কেন?
ডোরা বলল, মাসুদ ভাইয়ের কাছে চল।
আমরা মাসুদ ভাইকে খুঁজে পেলাম না। শুনলাম কোনো এক জায়গায় বসে জরুরি বৈঠক করছে। পাইকার ভাইকেও খুঁজে পেলাম না, মনে হয় একই সাথে একই মিটিংয়ে আছে। আমি কয়েকজনকে বলার চেষ্টা করলাম মাসুদ ভাইকে দরকার, খুবই জরুরি কিন্তু কেউ আমাদের একটুও পাত্তা দিল না। ছোট হওয়ার এই হচ্ছে সমস্যা কেউ গুরুত্ব দেয় না।
আমি বললাম, কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
ডোরা বলল, যদি তার মাঝে কিছু একটা হয়ে যায়?
আমি বললাম, হবে না। আমি তো এই রাজাকারের সাথে একই ঘরে, সারা রাত চোখে চোখে রাখব। কিছু করতে চাইলেই চিল্লিয়ে সবাইকে জাগিয়ে দেব।
রাত্রি বেলা আমি সত্যি সত্যি মানুষটাকে চোখে চোখে রাখলাম, না ঘুমিয়ে জেগে রইলাম। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম, নিজেই জানি না। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে জেগে আছি তাই ঘুমিয়ে গেছি, সেটাও বুঝতে পারছি না।