সপ্তাহ খানেক পর ইউসুফ শাহকে বর্ডার পার করে পাঠানোর জন্য মাসুদ ভাই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে রেডি করল। তারা কাঁকনডুবি গ্রামের কাছে দিয়ে যাবে, তাই মাসুদ ভাই আমাকে আর ডোরাকে জিজ্ঞেস করল আমরা বাড়িতে কোনো চিঠি পাঠাতে চাই কি না।
ডোরা অনেক সময় নিয়ে লম্বা একটা চিঠি লিখল, সেখানে ক্যাম্পের সব খবর আছে। আমরা যে খুব ভালো আছি সেটা সে ভালো করে বুঝিয়ে দিল। সবাই আমাদের যত্ন করে, বিশেষ করে ক্যাম্পের মা ডোরাকে আলাদাভাবে দেখে-শুনে রাখে, সেটাও সে খুব গুছিয়ে লিখে দিল।
আমি জীবনে চিঠি লিখি নাই, নানিও লেখাপড়া জানে না, তাই চিঠি লিখে কী লাভ হবে বুঝতে পারলাম না। ডোরা তখন আমাকে ধমক দিয়ে বলল ঢং করবি না। সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ–
বাধ্য হয়ে আমি চিঠি লিখলাম :
নানি,
আমার কদমবুচি লইবেন। পর সমাচার এই যে মুকতি বাহিনির কেম্পে আমরা ভালা আছি। আমার জন্য তুমি চিন্তা কুনু করিও না। আমি খুবই ভাল আছি। চিন্তার কুনু কারণ নেই। তুমি কেমন আছ? আশা করি তুমি ভালা আছ। আমি ভালা আছি। আমার জন্য দুয়া করিও এবং ডোরার জন্য দুয়া করিও। একই সাথে সব মুকতি বাহিনির জন্য দুয়া করিও।
ইতি
রঞ্জু।
আমার চিঠিটা দেখে ডোরা খুবই বিরক্ত হলো, বলল, এটা কী রকম ফালতু একটা চিঠি লিখেছিস?
আমি রেগে বললাম, আমার ইচ্ছে হলে আমি ফালতু চিঠি লিখব। তাতে তোর কী?
এক কথা বারবার। আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছ। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? তার ওপর কতগুলো বানান ভুল।
আমি বললাম, তাতে তোর সমস্যা কী? নানি লেখাপড়া জানে না– বানান ভুল থাকলেই কী আর না থাকলেই কী, কেউ একজন তাকে পড়ে শোনাবে
ডোরা তার পরও গজগজ করতে লাগল।
যাবার আগে ইউসুফ শাহ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেল। ঠিক রওনা দেয়ার আগে মা এসে দাঁড়ালেন। মুক্তিযোদ্ধা দুইজন মায়ের পা ধরে সালাম করল, মা তাদের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
ইউসুফ শাহও হঠাৎ কী মনে করে মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করল। মা এক মুহূর্ত ইতস্তত করে ইউসুফ শাহের মাথার হাত রেখে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
ইউসুফ শাহ হাত দিয়ে চোখ মুছে তার নিজের ভাষায় কী যেন বলল। তার কথাটা কী, আমরা কেউ বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু কী বলতে চাইছে, সেটা বুঝতে আমাদের কারো কোনো সমস্যা হলো না।
.
২২.
আমরা আস্তে আস্তে ক্যাম্পে দিন কাটানোতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। মুক্তিবাহিনী প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই একবার-দুবার করে অপারেশনে যায়। তারা এই অপারেশনগুলোকে বলে হিট অ্যান্ড রান–অর্থাৎ আক্রমণ করে সরে যাওয়া। সেই জন্য ক্ষয়ক্ষতি হয় খুব কম। কখনো কখনো দূর থেকে মর্টারের গোলা ফেলে চলে আসে। মাঝে মাঝে তাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। সারা রাত গোলাগুলি করে। সকাল হবার আগে চলে আসে। সবচেয়ে সোজা অপারেশন রাজাকার আর শান্তি কমিটির মেম্বারদের শাস্তি দেওয়া অপারেশন। এই অপারেশনগুলোর কারণে রাজাকারে যোগ দেওয়া কমে গেছে।
আগে আমাদের অস্ত্র খুব বেশি ছিল না, হঠাৎ করে অনেক অস্ত্র এসে গেছে। কয়েকদিন আগে মাসুদ ভাইয়েরা খবর পেয়েছে অস্ত্রের বিশাল একটা চালান আসছে। রাজাকাররা রাত জেগে নদীতে পাহারা দেয়, নৌকা দেখলেই সার্চ করে, তাই তাদের ওপর দায়িত্ব হলো রাজাকার বাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। মাসুদ ভাইয়েরা সময়মতো অপারেশন চালিয়েছে গোলাগুলি শুরু হতেই রাজাকারগুলো জান নিয়ে পালিয়েছে তখন অস্ত্রের নৌকাগুলো ভেতরে নিয়ে এসেছে। সেই অস্ত্রের ভাগ মাসুদ ভাইও পেয়েছে দুই নৌকা অস্ত্র। তাই মাসুদ ভাইয়ের মন-মেজাজ খুব ভালো। সেই অস্ত্র আমাদের ক্যাম্পে আনা হয়েছে, মাসুদ ভাই এখন সময় পেলেই সেই অস্ত্র হাত বুলিয়ে দেখে, মিষ্টি দেখে আমাদের জিবে যে রকম পানি চলে আসে, এই অস্ত্রগুলো দেখে মাসুদ ভাইয়ের জিবে সে রকম পানি চলে আসে।
শুধু যে অস্ত্র এসেছে তা নয়, একসাথে গ্রামের কমবয়সী অনেকগুলো মানুষ এসেছে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে। ইপিআরের সেই নিষ্ঠুর সুবেদার এই নূতন মুক্তিযোদ্ধাদের অত্যাচার করে যাচ্ছে! ক্রলিং করতে করতে তাদের কনুই আর হাঁটুর ছাল উঠে গেছে।
একদিন রাতে আমরা রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছি। কোনো একটা কারণে আজকে রেডিও শোনার জন্য খুব বেশি মানুষ নাই। নূতন যারা এসেছে, তাদের বেশ কয়েকজন বসে বসে চরমপত্র শুনতে শুনতে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জামাতে ইসলামীর ছাত্ররা কীভাবে নিয়াজীর পায়ের তলা ফেটে যাচ্ছে সেটা নিয়ে যখন টিটকারি করছিল তখন হঠাৎ একজন মানুষ উঠে দাঁড়াল। আমি খুবই অবাক হলাম, চরমপত্র এত মজার একটা অনুষ্ঠান সেটা শুনতে শুনতে কেউ উঠে যেতে পারে না। হয়তো তার খুবই বাথরুম চেপেছে–কিন্তু তবু আমার কেন জানি সন্দেহ হলো। তাই আসলেই বাথরুম করতে গিয়েছে কি না, দেখার জন্য আমি মানুষটার পেছনে পেছনে গেলাম। দেখলাম সে মোটেই বাথরুম করতে যায়নি। ব্যারাকে তার জায়গায় বসে বিছানার নিচ থেকে একটা নোটবই বের করে একটা টর্চলাইটের আলোতে কিছু একটা লিখছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মানুষটা ভীষণ চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি বললাম, আমি।
মানুষটা আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে প্রায় ধমক দিয়ে বলল, আমি কে?