আমরা একটু অবাক হয়ে মাসুদ ভাইয়ের কথা শুনছিলাম, আমরা এই সব কিছুই জানি না। আমাদের স্কুলে আমরা প্রত্যেক দিন সকালে পাকিস্তানের ফ্ল্যাগ টানাই, এসেমব্লিতে পাকিস্তানের মহান আদর্শের কথা বলি। পাকিস্তানের সেবা করে আদর্শ মুসলিম দেশ তৈরি করার কথা বলি। এই দেশের এত সমস্যা, সেটা এত দিন কেউ বলে নাই কেন?
মাসুদ ভাই বলল, সব রাজনৈতিক নেতাদের জেলে ভরে রেখেছে, আন্দোলন করার কেউ নাই। তখন আন্দোলন করল কারা? ছাত্ররা। আমার মতো ছাত্ররা। তোমাদের মতো ছাত্ররা। ঊনসত্তরে সে কী আন্দোলন! আইয়ুব খানকে কানে ধরে সরানো হলো, জেলখানা থেকে নেতারা ছাড়া পেলেন। কী একটা সময়! মাসুদ ভাইয়ের মুখটা আনন্দে ঝলমল করতে থাকে।
মামুন মুখ শক্ত করে বসে রইল, তার পছন্দের মানুষ আইয়ুব খানকে কানে ধরে সরানো হয়েছে বিষয়টা সে মানতে পারছে না।
বঙ্গবন্ধু জেল থেকে ছাড়া পেলেন—
একজন জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধু কে?
মাসুদ ভাই প্রশ্নটা শুনে মনে হলো একটু অবাক হলো, বলল, শেখ সাহেবকে সবাই বঙ্গবন্ধু ডাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাই হোক বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ঘুরে ছয় দফার ডাক দিলেন। ইলেকশন হলো–ইলেকশনে পূর্ব পাকিস্তানের দুইটা ছাড়া সবগুলো সিট বঙ্গবন্ধুর।
এবারে আমরা সবাই মাথা নাড়লাম, ইলেকশনের কথা আমাদের মনে আছে। আমাদের কাঁকনডুবিতে ইলেকশনের মিছিল হয়েছে, কয়েকটা শ্লোগানের কথা এখনও মনে আছে, সোনার বাংলা শ্মশান কেন? জবাব চাই জবাব চাই। ভোট দিবে কিসে? নৌকা মার্কা বাক্সে। বঙ্গবন্ধুর মার্কা ছিল নৌকা।
নৌকার বিপক্ষ পার্টির মার্কা ছিল গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুলের মিছিলে লোক কম হতো, মিছিলের পর পান-বিড়ি খেতে দিত, তার পরও লোকজন বেশি হতো না। মজা দেখার জন্য আমরা অবশ্যি সব মিছিলেই থাকতাম।
মাসুদ ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকল তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়াহিয়া খান বুঝতে পারে নাই ইলেকশনে বঙ্গবন্ধু এইভাবে জিতবে। যদি বুঝত তাহলে ইলেকশন দিত না। এখন তার কোনো উপায় নাই, এখন বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে হবে। এই প্রথম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে বাঙালি! মিলিটারিরা সেইটা সহ্য করতে পারছে না।
ঠিক কী কারণ জানি না, আমার কেমন জানি এক ধরনের উত্তেজনা হলো। বলাই কাকু কেন দুশ্চিন্তা করছিলেন এখন বুঝতে পারলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মিলিটারি যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে কী হবে মাসুদ ভাই?
মাসুদ ভাই একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, বাঙালিরা সেটা মেনে নেবে না। ক্ষমতা যদি না দেয় তাহলে কী হবে জানো?
কী হবে?
তাহলে আমরা আলাদা হয়ে যাব। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে।
মাসুদ ভাই কেমন যেন জ্বলজ্বলে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম মাসুদ ভাই মনে মনে চাইছে ইয়াহিয়া খান যেন ক্ষমতা না দেয় আর আমরা যেন স্বাধীন হয়ে যাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা স্বাধীন হলে দেশটার নাম কী হবে মাসুদ ভাই?
কে যেন বলল, পূর্ব বাংলা।
মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, না। বাংলাদেশ। দেশটার নাম হবে বাংলাদেশ।
আমি মনে মনে বললাম, বাংলাদেশ আর সাথে সাথে শরীরে কেমন জানি শিহরণ হলো। কেন হলো, কে জানে?
.
০৩.
কার কাছে যেন শুনেছিলাম সব গ্রামে নাকি একটা করে পাগল থাকে। কথাটা মনে হয় সত্যি, আমাদের গ্রামে একজন পাগল আছে, নাম হাবীবুর রহমান। আমাদের পাশের গ্রামেও একটা পাগল আছে, তাকে সবাই ডাকে নূরা পাগলা। তবে আমার মনে হয় সব গ্রামে শুধু পাগল না, কিছু ফালতু মানুষও থাকে। একজন পাগল আর কিছু ফালতু মানুষ না হলে একটা গ্রাম পুরো হয় না।
আমাদের গ্রামের যে পাগল হাবীবুর রহমান, তাকে দেখে বোঝাই যাবে না সে পাগল। সে খুবই স্বাভাবিকভাবে কথা বলে। কথা বলা শেষ করার পর হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর যেটা নিয়ে কথা বলেছে, সেটা নিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকে। তখন হঠাৎ করে সবাই টের পায় যে মানুষটার মাথায় গোলমাল আছে। হাবীবুর রহমান খুবই শান্তশিষ্ট পাগল, বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া সে আর কোনো ঝামেলা করে না। সেই তুলনায় আমাদের পাশের গ্রামের নূরা পাগলা রীতিমতো ভয়ংকর। তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়, তার পরও পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সে নাকি শিকল ভেঙে বের হয়ে যায়। হাতে দা নিয়ে সামনে যাকে পায় তাকেই কোপাতে থাকে। দশজন মানুষ মিলেও তখন নাকি তাকে ধরে রাখা যায় না। আমাদের যখন কোনো কাজ থাকে না তখন আমরা দলবেঁধে নূরা পাগলাকে দেখতে যাই। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, লম্বা লম্বা নখ, সারা গায়ে মাটি, লাল লাল চোখ, একটু পরেই হিংস্র পশুর মতো শব্দ করছে। দেখলেই ভয়ে বুক কাঁপে। আমাদের খুবই কপাল ভালো কাঁকনডুবি গ্রামের পাগল হাবীবুর রহমান খুবই শান্তশিষ্ট পাগল।
আমাদের গ্রামের ফালতু মানুষটার নাম মতি। পুরো নাম মতিউর রহমান, লতিফুর রহমানের ছেলে। যারা গরিব মানুষ তাদের ফালতু হলে সংসার চলে না, তাদের সবাইকে কাজকর্ম করতে হয়। সকালে গরু নিয়ে মাঠে যায় সারা দিন হালচাষ করে, ধান বোনে, খেতে সার দেয়, ধান বড় হলে ধান কাটে, বাড়িতে আনে মাড়াই দেয়। মাথায় করে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে– তাদের ফালতু হবার সময় কোথায়? কিন্তু আমাদের মতিউর রহমানের বাবা লতিফুর রহমান গ্রামের মাতবর। মুসলিম লীগের নেতা, টাকা-পয়সা আছে, জমি-জিরাত আছে, তাই মতি কোনো কাজকর্ম করে না। তিনবার পর পর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফেল করেছে, তখন বাবা লতিফুর রহমান রেগেমেগে সব বই বাড়ির উঠানে পুড়িয়ে দিয়েছে। তার পর থেকে মতিউর রহমানের আর কিছুই করতে হয় না, খায়-দায় ঘুরে বেড়ায়। আমরা তাকে আড়ালে ফালতু মতি ডাকি।