মাসুদ ভাই বলল, এখনো খুলি নাই তার একটা কারণ আছে। যত যাই বলি এই মানুষটা পাকিস্তানি মিলিটারি, তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় কি না এখনো জানি না। সে আমাদের যুদ্ধবন্দি, যুদ্ধবন্দিকে যুদ্ধবন্দির মতো রাখতে হবে।
মাসুদ ভাই কী বলছে ইউসুফ শাহ এবারে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তাই খানিকটা দুশ্চিন্তা নিয়ে একবার মাসুদ ভাইয়ের দিকে আরেকবার আমাদের দিকে তাকাতে লাগল।
পাইকার ভাই বলল, কমান্ডার, আমি তো এই মক্কেলের সাথে পুরা রাস্তা কথা বলতে বলতে আসছি, আমি আপনাদের বলতে পারি এই লোক পুরা জয় বাংলা! আমি এরে নিয়ে পরের অপারেশনে যেতে পারি, আমাগো সাথে হে যুদ্ধ পর্যন্ত করতে পারে।
মাসুদ ভাই বলল, হতে পারে। তবু আমি এত বড় ঝুঁকি নিতে পারব না।
জলীল নামের জ্ঞানী মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমি একে বিশ্বাস করি না। পাঞ্জাবিরা আমাদের সাথে যে অবিচার করেছে বেলুচিদের সাথে তার এক কণাও করে নাই। বাংলাদেশে বেলুচ রেজিমেন্ট জামালপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ করতেছে। তারা সেইখানে মানুষ মারতেছে। আমি এদের বিশ্বাস করি না।
একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, আমার মনে হয় আপনারা কয়েকজন মিলে ঠিক করেন কী করবেন! সবাই মিলে আলোচনা করে এটা ঠিক করতে পারবেন না।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো, কয়েকজন মিলে অনেকক্ষণ নিজেরা নিজেরা কথা বলল, তারপর সেটা ইউসুফ শাহকে বলা হলো। ইউসুফ শাহ মাথা নেড়ে রাজি হলো। তারপর তার হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো কিন্তু আমরা দেখলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে কাছাকাছি বসে আছে। ঠিক করা হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা একজন মুক্তিযোদ্ধা স্টেনগান নিয়ে তাকে পাহারা দেবে। ইউসুফ শাহ খুবই আনন্দের সাথে এই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধার যে দলটা অপারেশন করতে গিয়েছিল, আমরা তাদের পেছনে ঘুরঘুর করতে লাগলাম যুদ্ধের গল্প শোনার জন্য। সবাই ঠিক করে গল্প করতে পারে না, কিন্তু গল্প বলার মাঝে পাইকার ভাইয়ের তুলনা নাই। সে হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে অভিনয় করে মুখ দিয়ে শব্দ করে যুদ্ধের যা একটা বর্ণনা দিল সেটা আর বলার মতো না! যারা তার সাথে যুদ্ধ করে এসেছে তারাও পর্যন্ত যুদ্ধের পুরো ঘটনাটা পাইকার ভাইয়ের মুখ থেকে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনল।
গল্প শেষ করার পর যখন পাইকার ভাইয়ের আশপাশে কেউ নেই তখন আমি আর ডোরা তার কাছাকাছি গিয়ে গলা নামিয়ে বললাম, পাইকার ভাই, আপনাকে একটা কথা বলি?
বলো।
আগে বলেন আপনি করবেন।
কথাটা না বললে আমি কেমন করে বলব যে আমি করব? মনে করো এখন তুমি যদি আমাকে বলল যে শরীরে তেল মেখে ইউসুফ শাহের সাথে কুস্তি করতে হবে তাহলে আমি কোনো দিন রাজি হব না।
না, না, আপনাকে কারো সাথে কুস্তি করতে হবে না।
তাহলে আগে বলো আমাকে কী করতে হবে?
আমাকে আর ডোরাকে অস্ত্র চালানো শিখাবেন? রাইফেল স্টেনগান দিয়ে কেমন করে গুলি করতে হয়। কেমন করে গ্রেনেড ছুঁড়তে হয়–
তোমরা এত বাচ্চা! তোমরা গোলাগুলি শিখতে চাও?
ডোরা বলল, এখন তো যুদ্ধের সময়। যুদ্ধের সময় তো সবাইকে সবকিছু শিখতে হয়।
পাইকার ভাই বলল, ঠিক আছে দেখি। কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করে দেখি। যদি রাজি হয়–
আমরা নিঃশ্বাস ফেললাম। মাসুদ ভাইকে রাজি করানো খুবই কঠিন। তার ধারণা, যুদ্ধ খুবই খারাপ জিনিস, আমরা ছোট মানুষ, তাই যুদ্ধ থেকে আমাদের একশ হাত দূরে থাকতে হবে।
পাইকার ভাই কীভাবে কীভাবে জানি মাসুদ ভাইকে রাজি করিয়ে ফেলল, তারপর আমাদের ট্রেনিং শুরু হয়ে গেল। পাইকার ভাই খুব যত্ন করে আমাদেরকে রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান, কারবাইন চালানো শেখাল। সত্যিকারের গুলি দিয়ে শেখানো গেল না, তাহলে শব্দ হবে আর শব্দ শুনে পাকিস্তানিরা জেনে যেতে পারে আমরা এখানে আছি।
আমাদেরকে মর্টার দিয়ে কেমন করে শেল ছোঁড়া হয় সেটা দেখাল। তারপর গ্রেনেড কেমন করে ছুঁড়তে হয় সেটা শেখাল। ভেতর থেকে ডেটোনেটর খুলে আমাদের হাতে একটা গ্রেনেড দিয়ে কেমন করে সেফটি পিন খুলে লিভারটা জোরে চেপে ধরে রেখে দূরে ছুড়ে দিতে হয় সেটা শেখাল।
আমরা খুবই আগ্রহ নিয়ে গ্রেনেড ছোড়া শিখলাম। দুজনে মিলে অনেকবার প্র্যাকটিস করলাম। কে কতদূরে ছুঁড়তে পারি সেটা নিয়ে আমি আর ডোরা দুজনে মিলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করে দিলাম।
পাইকার ভাই খুবই খুশি হয়ে বলল, তোমরা দুজন খুবই ভালো গ্রেনেড ছোঁড়া শিখেছ। শুধু একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সেফটি লিভার ভোলার চার থেকে পাঁচ সেকেন্ড পরে তো এটা ফাটবে, তাই এটা ছোঁড়ার পরে, এই সময়ের মাঝে তোমাদের ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়তে হবে। তা না হলে নিজের গ্রেনেড়ে নিজেই মোরব্বা হয়ে যাবে।
পাইকার ভাই তারপর আমাদের ক্রলিং করা শেখাল, যুদ্ধের সময় নাকি মাথার ওপর দিয়ে গুলি যেতে থাকে, তখন একেবারে মাটির সাথে মিশে কনুইয়ে ভর দিয়ে ক্রলিং করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যেতে হয়।
আমি আর ডোরা তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে ক্রলিং করে সময় কাটালাম। দেখতে দেখতে আমাদের কনুইয়ের চামড়া খসখসে হয়ে উঠল।
আমরা যখন পাইকার ভাইয়ের কাছ থেকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিই তখন ইউসুফ শাহ গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, মাঝে মাঝেই কেমন যেন অবাক হয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ত। আমাদের মতো ছোট বাচ্চারা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পারি সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারত না।