তুই কেমন করে জানিস?
মা আমাকে বলেছে।
সত্যি? নিজে বলেছে?
হ্যাঁ। মা বলেছে কাউকে জন্ম না দিয়েই তার এতগুলো ছেলে!
ক্যাম্পের সবাই যে আসলেই মাকে মা মনে করে আমরা সেটাও দেখলাম। যখন গুলির বেল্ট গলায় ঝুলিয়ে, গ্রেনেডগুলো গামছায় পেঁচিয়ে কোমরে বেঁধে, রাইফেল এসএলআর ঘাড়ে নিয়ে সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে তখন মাসুদ ভাই বলল, মা, আপনি আসেন।
মা বললেন, আমার লজ্জা করে।
লজ্জা করলে হবে না। আসেন। আমাদের দোয়া করেন।
মা এসে দাঁড়ালেন, তখন সবাই তার পা ছুঁয়ে সালাম করল। মা সবার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ফি আমানিল্লাহ।
মাসুদ ভাই তার দলটা নিয়ে যখন রওনা দিয়েছে তখন পাইকার ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে তার হাতের এসএলআরটা ওপরে তুলে হুংকার দিয়ে বলল, যাই! কয়টা মিলিটারি মাইরা আই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কয়টা মারবেন পাইকার ভাই?
পাইকার ভাই বলল, তুমি বল।
আমি কিছু বলার আগেই ডোরা বলল, একশটা।
পাইকার ভাই সাথে সাথে বলল, ঠিক আছে।
আজকে ক্যাম্পে মানুষজন কম, রেডিওতে খবর শুনে আমরা সকাল সকাল শুয়ে পড়েছি। গভীর রাতে উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আকাশে মেঘ, মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। মেঘের আড়ালে চাঁদ, তাই চারদিকে কেমন জানি আবছা একধরনের আলো। এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে।
আমি উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
যুদ্ধ শুরু হয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, শোনো।
আমি কান পেতে শুনলাম সত্যি সত্যি বহুদূর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। একজন বলল, ঐ শোনো, জি থ্রি রাইফেল। পাকিস্তানিরা গুলি করছে।
আরেকজন বলল, এখন নাইন এম এম কারবাইন। এটা মাসুদ ভাই।
মুক্তিযোদ্ধারা গুলির শব্দ শুনেই বুঝে ফেলে কোনটা কে গুলি করছে। শুনতে শুনতে আমিও একসময় বুঝতে শুরু করলাম। পাকিস্তানি জি থ্রি রাইফেল কেমন জানি ট্যাক-ডুম-ট্যাক-ডুম শব্দ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র থেকে টানা কর্কশ শব্দ।
একটা বিস্ফোরণের শব্দ হতেই একজন বলল, গ্রেনেড। নিশ্চয়ই পাইকার।
প্রথম প্রথম পাকিস্তানিদের গুলি বেশি হচ্ছিল, আস্তে আস্তে তাদের গুলির শব্দ কমে এল। গ্রেনেডের শব্দ হলো অনেকগুলো, তারপর শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের শব্দ।
ক্যাম্পের সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করে চিৎকার করতে থাকে।
.
মাসুদ ভাইয়ের দল ফিরে এল পরের দিন দুপুরের দিকে। গত ছত্রিশ ঘণ্টা তাদের খাওয়া নাই, ঘুম নাই কিন্তু তাদের সবার মুখে হাসি। এ রকম যুদ্ধ তারা প্রায়ই করে। মাঝে মাঝেই সবাই ফিরে আসে না, এবার সবাই সুস্থ শরীরে ফিরে এসেছে আনন্দটা সে জন্য। এবারের আনন্দটা একটু বেশি, কারণ তারা একজন পাকিস্থানি মিলিটারিকে ধরে এনেছে।
পাকিস্তানি মিলিটারিটা প্রায় তালগাছের মতো লম্বা, কম বয়স, মুখে একটা ছেলেমানুষি ভাব, শুধু তাই নয়, চেহারায় ভয় বা আতঙ্ক কিছু নাই, বরং এক ধরনের আনন্দের ভবি। হাত দুটো পেছনে বাঁধা। এছাড়া তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে পাকিস্তানি মিলিটারি, তাদের সাথে এই দেশের মানুষ যুদ্ধ করছে।
কারণটা একটু পরে বোঝা গেল। মাসুদ ভাই একটা গুলির বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সবাইকে ডেকে বলল, তোমরা সবাই শোনো।
হইচই-চেঁচামেচি সাথে সাথে থেমে গেল। মাসুদ ভাই বলল, আল্লাহর কাছে হাজার পুকুর এই অপারেশন ষোলো আনার ওপর আনার ওপর আঠারো আনা না, একেবারে ছত্রিশ আনা সাকসেসফুল!
সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করে উঠল। মাসুদ ভাই বলল, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় হঠাৎ দেখি একজন পাকিস্তানি মিলিটারি দুই হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকে ছুটে আসছে আরেকটু হলে তাকে গুলি করে ফেলে দিতাম কিন্তু হাতে কোনো অস্ত্র নাই, দুই হাত ওপরে তুলেছে সারেন্ডার করার মতো তাই গুলি করলাম না–এত গোলাগুলির মাঝে যে তার শরীরে গুলি লাগে নাই সেইটা আল্লাহর কুদরত।।
সে এসে আমাদের মাঝখানে হাজির, আমাদের পাশে শুয়ে কী বলল জানো?
কী?
প্রথম কথাই হচ্ছে হাম জয় বাংলা হায়! হামকো গুলি মত করো–
আমরা সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করলাম! মাসুদ ভাই বলল, আমরা তাই আর গুলি করি নাই। নদীর ঘাটে যে কয়টা পাকিস্তানি মিলিটারি ছিল তারা পালিয়ে যাবার পর
একজন মাঝখানে জিজ্ঞেস করল, কয়টারে ফালাইছেন?
পাইকার ভাই বলল, খোকন আমাদের একশর টার্গেট দিছিল, মনে হয় টার্গেট পুরা হয় নাই।
আরেকজন বলল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে হবে তাহলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে।
মাসুদ ভাই বলল, মিলিটারি রাজাকার পালিয়ে যাবার পরই এই জয় বাংলা পাকিস্তান মিলিটারি বলয়ে সে বেলুচিস্তানের মানুষ। তার নাম ইউসুফ শাহ। পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের ওপর যে রকম অবিচার করে, ঠিক সে রকম বেলুচিদের ওপর অত্যাচার করে। বেলুচিরা মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করছে, বাঙালিরা করে নাই। বাঙালিরা বাঘের বাচ্চা। শিয়ালের জাতি হয়ে সে বাঘের বাচ্চাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না। যদি তার কপালে থাকে তাহলে দেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধবন্দি হিসেবে তার মা-ভাই-বোনের কাছে ফিরে যাবে। আর কপালে যদি না থাকে তাহলে এই বাঙাল মুলুকেই সে মরতে চায়।
ইউসুফ শাহ মাসুদ ভাইয়ের কোনো কথা বুঝে নাই কিন্তু তার পরও সে খুব জোরে মাথা নাড়তে লাগল। আমি মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, এ যদি জয় বাংলা হয় তাহলে তার হাত কেন বেঁধে রেখেছেন? হাতটা খুলে দেন?