পাইকার ভাই আমাদের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় করানোর কায়দাটা খুবই মজার। যেমন দূর থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সবুজ গেঞ্জি দেখেছ? এ হচ্ছে আমাদের উত্তম কুমার। প্রত্যেক দিন সকালে মুখের মাঝে সাবান ঘষে একটা ব্লেড হাত দিয়ে ধরে ক্যাড় ক্যাড় করে দাড়ি কামিয়ে ফেলে। উত্তম কুমার সব সময় ক্লিন শেভ। তারপর আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে লাল গামছা দেখেছ শুকনো মতন মানুষ? সে হচ্ছে বকর। বকরকে শুকনা দেখলে কী হবে সে হচ্ছে এক নম্বর খাদক। তার কপালের দুই ইঞ্চি বাদে পুরোটা পেট। বকর একা দশজনের খাবার খেয়ে ফেলে। শুধু নুন দিয়ে দুই গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারে। তারপর আরেকজনকে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সাদা পায়জামা দেখেছ। তার নাম জলীল, জলীলের ধারে-কাছে কখনো যাবা না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
পাইকার ভাই বলল, তার কারণ জলীল হচ্ছে আমাদের জ্ঞানী মানুষ। দুনিয়ার সবকিছু জানে। জলীলের কাছে বসলেই জ্ঞান দিতে শুরু করে। দেশ নিয়ে জ্ঞান, বিদেশ নিয়ে জ্ঞান, রাজনীতি নিয়ে জ্ঞান, যুদ্ধ নিয়ে জ্ঞান–দুই মিনিটে জ্ঞানের চাপে পাগল হয়ে যাবে। পাইকার ভাই গলা নামিয়ে বলল, আমরা কী ঠিক করেছি, জানো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী?
আমরা ঠিক করেছি এর পরেরবার যুদ্ধ করতে যাবার সময় জলীলকে মিলিটারি ক্যাম্পে রেখে আসব।
কেন?
সে তখন মিলিটারিদের এতই জ্ঞান দিতে শুরু করবে যে মিলিটারিরা বাপ বাপ করে দেশ ছেড়ে পালাবে। দুই দিনে দেশ স্বাধীন!
পাইকার ভাইয়ের কথা শুনে আমরা হি হি করে হাসতে থাকলাম।
.
মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে রাত্রিবেলা রেডিওটা অন করে সবাই সেটাকে ঘিরে বসেছে। কাঁকনডুবিতে যখনই কেউ রেডিও শুনেছে তখন ভলিউম খুব কমিয়ে শুনত গ্রামে রাজাকাররা ঘোরাঘুরি করে, তারা যদি জানতে পারে কেউ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই ক্যাম্পে সেই ভয় নাই তাই রেডিওটা একেবারে ফুল ভলিউমে চালু করা হয়েছে যারা দূরে বসেছে তারাও যেন ঠিক করে শুনতে পারে। রেডিওতে খবর শোনাল, কোথায় কোথায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে কয়টা পাকিস্তানি মিলিটারিকে মেরেছে তার হিসাব দিল। তারপর বজ্রকণ্ঠ শোনাল, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটা-দুইটা লাইনকে বলে বজ্রকণ্ঠ। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের জেলে কেমন আছেন কে জানে! বেঁচে আছেন না মেরেই ফেলেছে সেটাই বা কে জানে। তারপর কয়েকটা গান শোনাল। আমার সবচেয়ে প্রিয় গান, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে কিন্তু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি সেটা যখন শোনাচ্ছিল তখন সবাই হাত নেড়ে নেড়ে মাথা দুলিয়ে তাল দিচ্ছিল। তারপর শুরু হলো চরমপত্র, সবাই তখন নড়েচড়ে বসল। চরমপত্র থেকে মজার অনুষ্ঠান মনে হয় সারা পৃথিবীতে একটাও নাই। নাকি গলায় একজন বলতে লাগল, বাঙালি পোলাপান বিচ্ছুরা দুইশ পঁয়ষট্টি দিন ধইরা বাঙাল মুলুকের কেদো আর প্যাকের মইদ্যে ওয়ার্ল্ড ফাইটিং পজিশন পাইয়া আরে বাড়ি রে বাড়ি! ভোমা ভোমা সাইজের মুছুয়াগুলা ধক ধক কইরা দম ফালাইল… ইরাবতিতে জনম যার ইছামতিতে মরণ তার।… আমাগো বকশীবাজারের ছক্কু মিয়া ফাল পাইরা উঠল। বাইসাব, ১৯৭১ সালে বাঙাল মুলুকে মুছুয়া নামের মাল আছিল। হেগো চোটপাট বাইড়া যাওনের গতিকে হাজার হাজার বাঙালি বিচ্ছু হেগো পিঁপড়ার মতো ডইলা শেষ করছে!…
শুনে আমরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকি।
রাত যখন আরো গম্ভীর হলো তখন ডোরা শুতে গেল মুক্তিবাহিনীর মায়ের সাথে। আমাকে শুতে দেয়া হলো ব্যারাকের এক কোনায় আলাদা একটা বিছানায়।
শুয়ে শুয়ে আমি জঙ্গলের বিচিত্র সব শব্দ শুনতে লাগলাম। মাঝে মাঝে চাপা গলায় হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। নিশ্চয়ই যারা পাহারা দিচ্ছে তারা গল্পগুজব করছে। পাইকার ভাই বলেছে, জোছনা রাতে নাকি রাজকন্যার ভূতকে দেখা যায়, কোনো একদিন দেখতে হবে। তবে পাইকার ভাইয়ের গল্পকে বিশ্বাস করা মনে হয় ঠিক হবে না।
শুয়ে শুয়ে আমার নানির কথা মনে পড়ল। বেচারি নানি একা একা কেমন আছে?
.
২১.
সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা একটু অন্য রকম। সবাই মনে হয় সব কাজকর্ম ফেলে বসে বসে খুব যত্ন করে তার রাইফেল, এসএলআর কিংবা স্টেনগান পরিষ্কার করছে। কারণটা একটু পরেই বুঝতে পারলাম, আজ সন্ধ্যাবেলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল অপারেশনে যাবে। অন্যান্য দিনে সবাই যে রকম হইচই-চেঁচামেচি করে আজকে সে রকম নেই, সবাই মনে হয় একটু চুপচাপ। মনে হয় যুদ্ধে যাবার আগে সবাই এ রকম চুপচাপ হয়ে যায়।
দুপুরে মা সবাইকে ভাত বেড়ে দিল। বেশি কথা না বলে সবাই খেয়ে নিল। খেতে খেতে ডোরা আমাকে ফিসফিস করে বলল, মা এখানে কোথা থেকে এসেছে জানিস?
না। কোথা থেকে?
রাজাকাররা মাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন মাসুদ ভাইয়ের দল অ্যামবুশ করেছে।
সত্যি?
হ্যাঁ। মাকে উদ্ধার করে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে তখন কী হয়েছে জানিস?
কী হয়েছে?
তার বাড়ি থেকে বলেছে তাকে বাড়িতে রাখবে না।
কেন?
রাজাকাররা মাকে অত্যাচার করেছিল সেই জন্য। আমি ছোরার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ডোরা থামিয়ে দিয়ে বলল, তখন মাসুদ ভাই মাকে তাদের সাথে ক্যাম্পে নিয়ে এসেছে। সবাই মিলে এখানে তাকে মা ডাকে!