বিক্রি করে দিল?
হ্যাঁ। আগের যুগে সব সময় মানুষকে ধরে বিক্রি করে দিত। যাই হোক শুধু একজন রাজকন্যা বেঁচে গেল। সে একা একা এখানে ঘুরে বেড়াত। সবাই মারা যাওয়ার পরও সে একা এইখানে থেকে গেল! তারপর একদিন সে নিজেও মারা গেল–তার পরও সে এখানে থেকে গেল।
মারা যাওয়ার পরে?
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল বলল, হ্যাঁ। ভূত হয়ে। এখনো আছে।
আমি আর ডোরা চিৎকার করে উঠলাম, এখনো আছে?
হ্যাঁ। গভীর রাত্রে যদি ঘুম থেকে ওঠো শুনবে সেই রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সত্যি?
আমার কথা বিশ্বাস না করলে গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে বসে থেকো। তোমাদের যদি কপাল ভালো হয় তাহলে জোছনা রাতে দেখতেও পেতে পারো।
ডোরা বলল, থাক বাবা, আমার দেখার কোনো দরকার নাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, পাইকার ভাই। আপনি কি কখনো ভূত দেখেছেন?
দেখি নাই আবার!
কী রকম ছিল ভূতটা?
দিনের বেলা ভূতের গল্প বলে কোনো মজা নাই, অন্ধকার হোক তখন বলব। এখন চলো ক্যাম্পের পেছন দিকটা দেখাই।
ক্যাম্পের পেছন দিকে গিয়ে দেখলাম একজন মহিলা একটা মাটির চুলায় বড় বড় ডেকচিতে রান্না করছেন। চুলায় আগুন ধরাতে সমস্যা হচ্ছে, তাই একটা চোঙা দিয়ে ফুঁ দিচ্ছেন, চুলা থেকে আগুন বের না হয়ে ধোয়া বের হচ্ছে আর মহিলা ধোয়া থেকে মাথাটা সরানোর চেষ্টা করছেন।
পাইকার বলল, এই যে ইনি হচ্ছে আমাদের মা। মা শুনে ভেবেছিলাম বুঝি মা-খালাদের মতো বয়স্কা একজন মহিলা হবেন কিন্তু যখন ঘুরে আমাদের দিকে তাকালেন, তখন দেখলাম কমবয়সী একটা বউ। কাল রাতে আমাদের মুড়ি-কলা দিয়েছিলেন তখন অন্ধকারে চেহারা দেখতে পারি নাই, এখন দেখতে পাচ্ছি খুবই ফুটফুটে চেহারার কমবয়সী একটা মেয়ে। ডোরা ফিসফিস করে বলল, ইশ! কী সুইট!
পাইকার ভাই বলল, এই হচ্ছে মা, আর আমরা সবাই তার দামড়া-দামড়া ছেলে। পাইকার ভাই তখন মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মা, এই যে তোমার আরো দুইটা ছেলে! এইগুলি আমাদের মতো দামড়া সাইজের না এরা আণ্ডাবাচ্চা।
মা মুখ টিপে হেসে বললেন, দুইটা ছেলে না, একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে।
পাইকার ভাই চোখ কপালে তুলে বলল, কী বলেন আপনি?
ঠিকই বলি।
পাইকার ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কী সর্বনাশ! কোনটা ছেলে কোনটা মেয়ে? দুইটাই তো দেখতে একই রকম?
ডোরা ফিক করে হেসে বলল, একসময় আমাদের একজন মেয়ে ছিল, এখন আমরা দুইজনই ছেলে। তাই নারে রঞ্জু?
আমি মাথা নাড়লাম। পাইকার ভাই ডোরার দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি নিশ্চয়ই মেয়ে!
ডোরা মাথা নাড়ল আর পাইকার ভাই এমন একটা ভাব করল যে একটা রাজ্য জয় করে ফেলেছে।
মা তখনো চোঙা দিয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে, তখন পাইকার ভাই এগিয়ে গিয়ে বলল, দেন আমার কাছে দেন, আমি আগুনটা ধরিয়ে দিই।
মা বললেন, লাগবে না। আমিই পারব।
আপনি তো পারবেনই। আপনি কোন কাজটা পারেন না! এর পরেরবার আপনাকে যুদ্ধে নিয়ে যাব। একটা মেশিনগান দিয়ে বসিয়ে দেব। মিলিটারিগুলোকে ছাতু করে দেবেন। মোরব্বা বানিয়ে দেবেন।
পাইকার ভাই চোঙাটা নিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা ফুঁ দিতেই দপ করে আগুনটা জ্বলে উঠল। পাইকার ভাই নিজের বুকে থাবা দিয়ে এমন একটা ভান করল যে এবারে শুধু রাজ্য না, আস্ত একটা সাম্রাজ্য জয় করে ফেলেছে। খুব অল্পতেই পাইকার ভাই খুশি হয়ে ওঠে।
মা ডেকচির ঢাকনা সরিয়ে ভেতরের তরকারিটা একটা বাঁশের হাতা দিয়ে নেড়ে দিতে থাকলেন। পাইকার ভাই সেটা দেখতে দেখতে বলল, মা আসার আগে আমাদের ভাতের অর্ধেক থাকত চাউল, বাকি অর্ধেক থাকত জাউ। ডালের রং হতো কলেরা রোগীর ইয়ের মতো। মাছের তরকারির মাঝে আমরা একদিন এত বড় একটা কোলা ব্যাঙ পেয়েছিলাম। ব্যাটা সিদ্ধ হয়ে গেছে! খাওয়া ছিল শূল বেদনার মতো যন্ত্রণা। আমরা ভেউ ভেউ করে কাঁদতাম আর খেতাম। খেতে খেতে বলতাম ওরে শালার ইয়াহিয়া তোর জন্য আজকে আমাদের এত কষ্ট।
ডোরা বলল, আর এখন?
এখন মায়ের রান্না এতই ভালো যে যদি মা একটা কোলা ব্যাঙকে রেন্দে দেয় সেইটাই আমরা কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলব। ভাত রাঁধলে মনে হয় পোলাও। বেগুন ভর্তা বানালে মনে হয় কোরমা। পাইকার ভাই হাতে কিল দিয়ে বলল, যখন দেশ স্বাধীন হবে তখন আমি কী করব জানো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী?
ঢাকা শহরে একটা রেস্টুরেন্ট দেব, রেস্টুরেন্টের নাম হবে দ্য গ্রেট মা রেস্টুরেন্ট, মা রাঁধবে আর আমি কাস্টমারদের খাওয়াব। এক সপ্তাহে লাখপতি হয়ে যাব।
মা পাইকারের কথা শুনে কোনো কথা না বলে মুখ টিপে হাসতে হাসতে রাঁধতে লাগলেন।
পাইকার ভাই তারপর ক্যাম্পের পেছন থেকে আমাদের ক্যাম্পের সীমানা পর্যন্ত নিয়ে গেল। একদিকে একটা খাল, সেখানে জংলি কাঁটা গাছে বোঝাই। তিন দিকে জঙ্গল। সেখানে বড় বড় গাছে মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় পাহারায় থাকে।
ক্যাম্পের এক পাশে পানির জন্য একটা কুয়া করা হয়েছে। গভীর কুয়ার নিচে টলটলে পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুমানোর জন্য ব্যারাক করা হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ওপরে খড়ের ছাউনি। মাটিতে খড় বিছিয়ে সেখানে ঘুমানের ব্যবস্থা।
দালানের ভেতরে একটা ঘরের মাঝে সব গোলাবারুদ আর অস্ত্র সাজানো। সেই ঘরের সামনে একজন সব সময় একটা স্টেনগান নিয়ে পাহারা দেয়।