মাসুদ ভাই আবার হাসল, এইটা হচ্ছে মিলিটারি ট্রেনিংয়ের একটা অংশ।
ডোরা বলল, খুবই নিষ্ঠুর মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের কত কষ্ট দিচ্ছেন।
মাসুদ ভাই বলল, ট্রেনিংয়ের সময় যত বেশি কষ্ট করবে, যুদ্ধটা হবে তত সহজ।
আমি বললাম, এইভাবে কষ্ট দিলে সবাই তো পালিয়ে যাবে।
না। পালাবে না। কেউ পালায় নাই। এদের একজনকেও তো আমরা ধরে আনি নাই, এরা নিজেরা এসেছে। কাউকে আমরা এক টাকা বেতনও দিই না। তবু এরা আছে।
নাই-নাই-আমি নাই। কথা শুনে আমরা ঘুরে তাকালাম, গলার স্বর শুনে বুঝতে পারলাম মানুষটা পাইকার। কাল রাতে যখন আসছিলাম তখন সে পাহারায় ছিল। গলার স্বর শুনে ভেবেছিলাম বয়স্ক মানুষ, এখন দেখছি কমবয়সী একজন ছেলে।
মাসুদ ভাই আবার তার বাক্সের ভেতর থেকে গুনে গুনে গ্রেনেড বের করতে করতে বলল, কেন তুমি নাই?
গত পরশু শুঁটকি দিয়ে ভাত খেয়েছি, গতকালও ছিল শুঁটকি, আজকেও শুঁটকি। আমি আর নাই। আমি কাঁকনডুবি গিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেব। মিলিটারি ক্যাম্পে প্রত্যেক দিন গরুর গোশত।
খুব ভালো আইডিয়া পাইকার। শুধু খোঁজ নাও রাজাকাররা গরুর গোশতের ভাগ পায়, নাকি তারাও খালি শুঁটকি খায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। প্রত্যেক দিন মিলিটারির গা-হাত-পা টিপে দিতে হবে। পারবে তো!
ছি! ঐ হারামজাদাদের গা-হাত-পা টিপতে হবে–তাহলে আমি এইখানে আছি। শুঁটকিই সই! দরকার হলে কচু খেয়ে থেকে যাব!
পাইকার তখন আমাদের দুইজনের দিকে তাকাল, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমাদের আণ্ডা-বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধাদের কী খবর?
ডোরা বলল, আমরা যদি আণ্ডা-বাচ্চা মুক্তিযোদ্ধা হই তাহলে আপনি কী?
পাইকার বলল, তা তো জানি না! মনে হয় বাছুর মুক্তিযোদ্ধা।
শুনে আমি আর ডোরা দুইজনেই হি হি করে হাসলাম। ডোরা বলল, আপনার নাম তো পাইকার। তাই না?
হ্যাঁ। তাতে কোনো সমস্যা আছে?
সমস্যা নাই। কিন্তু এই নামটা আমি আগে কখনো শুনি নাই।
কেমন করে শুনবে? পৃথিবীতে মাত্র হাতে গোনা অল্প কয়েকজন পাইকার আছে। পাইকার হচ্ছে অমূল্য ধন।
কিন্তু পাইকার ভাই, এই নামটা কেমন করে এসেছে?
ও! সেটা তো বিরাট কাহিনি। আমার বাবা-মায়ের কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না। তখন আমার মা বাবাকে বলল, হ্যাঁ গো, আমাদের কোনো ছেলেমেয়ে নাই। ঘরটা খালি খালি লাগে, তুমি বুধবারের হাট থেকে কয়টা ছেলেমেয়ে কিনে আনো না গো।
ডোরা হি হি করে হেসে বলল ইশ! কী মিথ্যুক। ছেলেমেয়ে কেউ কোনো দিন হাট থেকে কিনে আনে?
পাইকার ভাই অবাক হবার ভান করে বলল, ও মা! হাটবাজার থেকে না কিনলে ছেলেমেয়ে আসে কোথা থেকে?
ডোরা বলল, মিথ্যুক! মিথ্যুক!
পাইকার ভাই খুবই দুঃখ পাবার ভঙ্গি করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে থাক। আমি তাহলে বলবই না।
আমি আর ডোরা তখন বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি বলেন।
মিথ্যুক বলবে না তো?
না, বলব না।
ঠিক আছে, তাহলে শোনো। বাবা বাজারে গিয়ে দোকানে দোকানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে টিপে টুপে দেখে কিন্তু পছন্দ হয় না। শেষে একটা দোকানে বাচ্চাগুলো দেখে খুব পছন্দ হলো। বাবা জিজ্ঞেস করল, কত করে দাম? দোকানদার বলল, খুচরা না পাইকারি? বাবা বলল পাইকারি। দোকানদার বলল এক দাম, জোড়া দুইশ টাকা। বাবা তখন পাইকারি দরে পাঁচ জোড়া বাচ্চা কিনে আনল। বাজার থেকে পাইকারি কিনেছে বলে আমাদের নাম পাইকার।
ডোরা আবার হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, মিথ্যুক। মিথ্যুক!
পাইকার ভাই চোখ গরম করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হলো? ঠিক আছে যুদ্ধ শেষ হলে আমি তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। আমার মাকে জিজ্ঞেস করো আমি সত্যি কথা বলছি, না মিথ্যা বলছি।
মাসুদ ভাই মুখ টিপে হাসছিল, বলল, পাইকার! এই রকম গাঁজাখুরি গল্প তোমার স্টকে কয়টা আছে?
একটাও নাই। আমার স্টকে যা আছে, সব সত্যি! কোনো ভেজাল নাই!
ডোরা বলল, আপনি একজন জোকার। তাই না?
পাইকার ভাই বুকে থাবা দিয়ে বলল, আমি মোটেও জোকার না।
তার বলার ভঙ্গি দেখেই আমি আর ডোরা হি হি করে হাসতে লাগলাম। মানুষটাকে আমাদের খুবই পছন্দ হলো।
.
বিকালবেলা পাইকার ভাই আমাকে আর ডোরাকে নিয়ে পুরো ক্যাম্পটা দেখাতে বের হলেন। পুরনো দালানটা দেখিয়ে বলল, এইটা কিসের দালান কেউ জানে না। ভাসা ভাসাভাবে শুনেছিলাম মোগল আমলে এইখানে একজন রাজপুত্রকে নির্বাসন দিয়েছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
কে বলবে কেন? রাজা-বাদশাহরা সিংহাসনে বসার জন্য এক রাজপুত্র অন্য রাজপুত্রকে মেরে ফেলে, না হলে চোখ কানা করে দেয়।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। এই জন্যই তো আমি ইতিহাস বই পড়ি না, পরীক্ষায় সেই জন্য গোল্লা পাই। যাই হোক, রাজপুত্রের জন্য এইখানে নদীর তীরে এই রাজপ্রাসাদ তৈরি করে দিল। সে তার এক ডজন বউ, দুই ডজন দাসি বান্দি, তিন ডজন পাহারাদার, চার ডজন পোলাপান নিয়ে থাকতে এল। তখন একদিন
ডোরা জিজ্ঞেস করল, নদীটা কই?
নদীটা সরে গেছে।
নদী সরে গেছে? নদী কি জ্যান্ত মানুষ যে সরে যাবে?
পাইকার ভাই মাথা নাড়ল, বলল, আমি এত কিছু জানি না। যেটা শুনেছি, সেটা বলছি। পছন্দ না হলে কানে আঙুল দিয়ে রাখো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে আপনি বলেন।
যাই হোক এই রাজপুত্র এক জোছনা রাতে নদীর তীরে বসে মদ গাঞ্জা এই সব খাচ্ছে
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মদ-গাঞ্জা?
হ্যাঁ। রাজা-বাদশাহরা সব সময় সময় কাটানোর জন্য মদ-গাঞ্জা খায়। যাই হোক তখন ডাকাতেরা আক্রমণ করল। সবাইকে কচুকাটা করে সবকিছু লুটপাট করে নিল! ছোট বাচ্চা আর মেয়েদের ধরে নিয়ে বিক্রি করে দিল।