মাসুদ ভাই বলল, অনেক হয়েছে। এখন তুমি ঘুমাতে যাও। কাসেমকে পাহারায় পাঠাও।
পাইকার নামের মানুষটা আমাকে আর ডোরাকে দেখে বলল, ইয়া মাবুদ! মাসুদ ভাই, আপনি কি জানেন আপনার কাঁকনডুবি থেকে একটা ট্যাবলেট আনার কথা ছিল, আপনি দুইটা নিয়া আসছেন?
জানি। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, এ হচ্ছে রঞ্জু। যাকে আনার জন্য গিয়েছিলাম। আর এ হচ্ছে খোকন–রঞ্জুকে আনতে গিয়ে আমরা খোকনকে ফ্রি পেয়ে গেছি।
পাইকার বলল, এই রকম আণ্ডা-বাচ্চা আমরা কয় হালি আনব? এদের জন্য আমাদের তো এখন দুধের বোতল কিনতে হবে।
সেইটা নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। এরা খুবই টায়ার্ড, মাকে ঘুম থেকে তোলো। এদের কিছু খেতে দাও, তারপর ঘুমানোর ব্যবস্থা করো।
জো হুকুম কমান্ডার , বলে পাইকার অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমাদের অন্ধকারের ভেতর একটা ঘরের মতো জায়গায় নেয়া হলো। সেখানে মাটিতে খড় রেখে তার ওপর একটা কাঁথা বিছিয়ে বিছানা করা হয়েছে। নূতন জায়গায় এসে আমার আর ডোরার দুজনেরই একটু অস্বস্তি লাগছিল। আমাদের জন্য বাটিতে মুড়ি আর কলা আনা হয়েছে, আমরা দুজন প্রায় রাক্ষসের মতো সেগুলো খেয়ে ফেললাম। তারপর আমি বিছানায় শুয়ে কিছু বোঝার আগেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙল পরের দিন বেলা হবার পর। আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল ডোরা, বলল, বাইরে আয়। দেখ।
আমি বাইরে এসে অবাক হয়ে গেলাম। গভীর জঙ্গলের মাঝখানে অনেক পুরনো একটি দালান, তার বেশির ভাগ মাটির ভেতর গেঁথে আছে। ইটগুলো অনেক চিকন। দালানগুলো লতাপাতা দিয়ে ঢাকা–তার অনেকটুকু পরিষ্কার করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তৈরি হয়েছে।
ক্যাম্পের এক পাশে প্রায় পনেরো-বিশজন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং করছে। আধবুড়ো একজন মানুষ একটা হুংকার দিতেই সবাই মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে সামনে এগোতে থাকে, আবার হুংকার দিতেই তারা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আরেকটা হুংকার দিতেই তারা দৌড়াতে থাকে। আধবুড়ো মানুষটার মনে কোনো দয়ামায়া নাই, মুক্তিযোদ্ধাগুলো দরদর করে ঘামছে দেখে মনে হয় আর এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার পরও তাদেরকে দৌড়িয়ে নিতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত আধবুড়ো মানুষটার মনে হলো একটু দয়া হলো, তখন সবাইকে থামতে বলতেই সবাই মাটির ওপর নেতিয়ে পড়ে মুখ হাঁ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে থাকে। আধবুড়ো মানুষটা তখন গালাগাল শুরু করল, হেই ইন্দুরের বাচ্চারা! তোরা কি মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিংয়ের জন্য আসছস, নাকি রাজাকারদের ট্রেনিংয়ের জন্য আসছস? এইটা রাজাকারের ট্রেনিং না যে একটা লাঠি নিয়া দুই কদম লেফট-রাইট করবি। এইটা মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং। নিজের জান কবজ কইরা যুদ্ধ করা লাগব! যুদ্ধ করতে মাথার মাঝে বুদ্ধি থাকতে হয়, বুকের মাঝে সাহস থাকতে হয় আর শরীলে শক্তি থাকতে হয়। তোদের মাথার মাঝে কোনো ঘিলু নাই, বুকের মাঝে কোনো সাহস নাই, শরীলে জোর নাই। দেখলে মনে হয় কয়টা বুইড়া মানুষ কুঁই কুঁই কইরা হাঁটে। তোগো দেখলে মনে হয় গলায় হাত দিয়া বমি কইরা দিই–এই ইন্দুরের বাচ্চাদের নিয়া আমাগো যুদ্ধ করা লাগব? তোদের দিয়া দেশ স্বাধীন করতে হলে একশ বছর যুদ্ধ করা লাগব। তারপর হুংকার দিয়ে বলল, খাড়া হ।
সবাই তখন এক লাফে উঠে দাঁড়াল। আরেকটা হুংকার দিতেই সবাই ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল। আরেকটা হুংকার দিতেই কনুইয়ে ভর দিয়ে সবাই গিরগিটির মতো সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু নিশ্চয়ই এতক্ষণে সবার কনুইয়ের ছাল উঠে গেছে।
ঠিক তখন আমি দেখলাম একটা ফাঁকা জায়গায় মাসুদ ভাই একটা বাক্স খুলে ভেতরে কী যেন দেখছে। আমি আর ডোরা তার কাছে হেঁটে গেলাম। আমাদের দেখে মাসুদ ভাই বলল, ঘুম হয়েছে রাত্রিবেলা?
হয়েছে।
গুড। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখছেন?
গ্রেনেড। কয়টা আছে গুনছি। কাল-পরশু একটা অপারেশনে যাব তো।
কোথায়?
কালী গাংয়ের উজানে। আমাদের অনেক বড় একটা অস্ত্রের চালান আসছে। অস্ত্রবোঝাই নৌকাটা যেন ঠিকমতো আসতে পারে সেই জন্য মিলিটারি পাহারাকে একটু ব্যস্ত রাখতে হবে।
আমি বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হলো?
আমাদের আপনাদের সাথে নিয়ে যাবেন? মাসুদ ভাই চোখ কপালে তুলে বলল, তোমাদের?
হ্যাঁ, আমরা কখনো যুদ্ধ দেখি নাই।
মাসুদ ভাই হাসল, বলল যুদ্ধ তো থিয়েটার না যে সবাই বসে বসে দেখবে। যুদ্ধ খুব ভয়ানক ব্যাপার। যুদ্ধে একদল আরেক দলকে মারে! এখানে দেখার কিছু নাই।
ডোরাও আমার সাথে যোগ দিল, বলল, আমরা অনেক দূর থেকে দেখব। আপনাদের গুলির বাক্স নিয়ে দেব।
মাসুদ ভাই এবার শব্দ করে হেসে আঙুল দিয়ে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে বলল, ঐ দেখেছ, মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে ট্রেনিং নিচ্ছে? এই রকম ট্রেনিং না নিয়ে কেউ যুদ্ধে যায় না! তোমরা ঐ ট্রেনিং নিতে পারবে?
আমি আর ডোরা একসাথে বললাম, পারব।
গুড। তাহলে ট্রেনিংটা নিয়ে নাও।
আমি আড়চোখে ট্রেনিং নিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা আর হুংকার দিতে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম, মাসুদ ভাই।
কী হলো?
ঐ লোকটা কে?
ই.পি.আরের একজন সুবেদার। কেন?
উনি মুক্তিযোদ্ধাদের এত গালাগালি করেন কেন?