মাসুদ ভাই বলল, ঠিক আছে তাহলে আমরা দাঁড়াই, তুমি ডোরাকে বলে এসো।
ঠিক আছে।
দেরি করো না। রাজাকারদের বাড়ির সামনে মুক্তিযোদ্ধা পাহারা রেখেছি কিন্তু এই রাতে আমি গোলাগুলি করতে চাই না।
ঠিক আছে। আমি অস্বস্তির সাথে বললাম, এখন ডোরাকে বোঝাতে পারলে হয়। তার মাথায় একটা জিনিস ঢুকে গেলে সেটা আর বের করা যায় না।
দেরি করো না। যাও।
কিছুতেই রাজি হবে না। আমাকে খুন করে ফেলবে।
মাসুদ ভাই তাড়া দিল, যাও যাও, অড়াতাড়ি যাও। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমি এটা করতে দিচ্ছি।
ডোরাদের বাড়ির কুকুরটা আমাকে দেখে একটা হালকা ডাক দিল কিন্তু কাছে এসে আমাকে চিনতে পেরে পরিচিত মানুষের মতো লেজ নাড়তে লাগল। আমি ডোরার ঘরের জানালায় গিয়ে টোকা দিলাম, সত্যি সত্যি সাথে সাথে ডোরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে?
আমি চাপা গলায় বললাম, আমি রঞ্জু।
ডোরা তখনই জানালাটার পর্দা সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে রঞ্জু? মুক্তিবাহিনী এসেছে?
হ্যাঁ।
সত্যি?
সত্যি।
এখন যুদ্ধ করবে? ক্যাম্প আক্রমণ করবে?
না।
তাহলে? আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, আমাকে নিতে এসেছে।
আর আমি?
তোকে মানে তোকে তুই তো মানে– আমি কথা শেষ করতে পারলাম না।
ডোরা প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, বুঝেছি। আমাকে নিবি না। তুই একা যাবি। তুই আমাকে কিন্তু কথা দিয়েছিলি–
দেখ ডোরা, মাসুদ ভাই খবর পেয়েছে রাজাকাররা আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। সেইজন্য আমাকে নিতে এসেছে। আমি তো চলেই যেতে পারতাম। কিন্তু তোকে কথা দিয়েছি তাই তোকে না বলে যাই নাই।
ডোরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল, ঠিক আছে, তুই যা।
তুই রাগ করছিস?
ডোরা আমার কথার উত্তর দিল না। আমি বললাম, দেখ ডোরা, আমি তোকে কথা দিচ্ছি আমি তোকে নিতে আসব
তোর আর কথা দিতে হবে না। তুই যা।
দেখ ডোরা।
তুই যা। বলে ডোরা জানালার পর্দা টেনে দিল। আমার মনে হলো ডোরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমি খুব মন খারাপ করে মাসুদ ভাইয়ের কাছে এলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, বলেছ?
হ্যাঁ। বলেছি।
গুড। এখন তাহলে চল যাই।
ডোরা খুব মন খারাপ করেছে।
মাসুদ ভাই কোনো কথা বলল না, আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগল। আমি আবার বললাম, ডোরা আমার ওপর মনে হয় খুব রাগ হয়েছে। তার এত মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা।
মাসুদ ভাই এবারেও কোনো কথা বলল না। আমি বললাম, ডোরা আমার সাথে ভালো করে কথাই বলল না।
মাসুদ ভাই বলল, যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে তখন আমি তোমার পক্ষ থেকে ডোরার কাছে মাফ চেয়ে নেব। ঠিক আছে?
আমি বললাম, ডোরা মাফ করবে না। কোনো দিন মাফ করবে। ডোরার খুব রাগ।
গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে পাহারা দিচ্ছিল তাদের সবাইকে একত্র করে মাসুদ ভাই রওনা দিল। আকাশে মেঘ, মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। এর মাঝে সবাই পা চালিয়ে হাঁটছে। মাসুদ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি হাঁটতে পারছ তো?
পারছি, মাসুদ ভাই।
কষ্ট হলে বলো। তোমাকে ঘাড়ে তুলে নেয়া যাবে।
লাগবে না মাসুদ ভাই। আমি ঠিক হয়ে গেছি।
.
ঘণ্টা খানেক পর আমরা একটা জলা জায়গা পার হলাম। জায়গাটা পার হবার পর গভীর জঙ্গল, মনে হয় সবাই এই জঙ্গলে ঢুকে যাবে।
হঠাৎ করে মাসুদ ভাই থেমে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ।
আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই ফিসফিস করে বলল, শোনো।
আমরা সবাই কান পেতে শুনলাম, একটা ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। কেউ একজন জলা জায়গাটা পার হচ্ছে।
মাসুদ ভাই বলল, নিশ্চয়ই রাজাকার। আমাদের ক্যাম্পটা কোথায় জানার জন্য পিছে পিছে আসছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘাড়ে ঝোলানো স্টেনগানটা হাতে নিয়ে বলল, শেষ করে দেব?
না, গুলি করা যাবে না। ধরে আনতে হবে।
আপনি থাকেন, আমরা দুইজন যাই।
মুক্তিযোদ্ধা দুইজন অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, তখন হঠাৎ একটা হুটোপুটির শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা দুইজন একজনকে ধরে নিয়ে এল। মাসুদ ভাই মানুষটার মুখে টর্চের আলো ফেলল, সাথে সাথে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ডোরা!
ডোরা চোখ পিটপিট করে বলল, রঞ্জু দেখবি একটু, আমার মনে হচ্ছে আমার পায়ে একটা জোঁক ধরেছে।
৪. ক্যাম্পে পৌঁছেছি
চতুর্থ পর্ব
২০.
আমরা প্রায় সারা রাত হেঁটে হেঁটে ভোররাতের দিকে ক্যাম্পে পৌঁছেছি। যেখানে তারা ক্যাম্প বসিয়েছে সেখানে রাজাকার আর মিলিটারি দূরে থাকুক কাকপক্ষীও সেটা খুঁজে পাবে না। যখন ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছেছি তখন একটা গাছের ওপর থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল, হলট! হু কামস দেয়ার?
সেই বিকট চিৎকার শুনে আমি আর ডোরা রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম, মাসুদ ভাই বলল, হয়েছে হয়েছে পাইকার, এখন গাছ থেকে নাম।
গাছের ওপর থেকে যে চিৎকার করেছে সে বলল, কভি নেহি। আমাকে পাসওয়ার্ড না বলা পর্যন্ত যেতে দেব না। বলেন পাসওয়ার্ড।
মাসুদ ভাই বলল, পাসওয়ার্ড জানি না।
ভেরি গুড। হয়েছে।
কেমন করে হলো?
গাছ থেকে পাইকার নামের মানুষটা নামতে নামতে বলল, তার কারণ আজকের পাসওয়ার্ড হচ্ছে জানি না। কালকের পাসওয়ার্ড ছিল, ভুলে গেছি। আমরা সব সময় খুব বুদ্ধিমানের মতো পাসওয়ার্ড দিই। তাই না কমান্ডার?