তুই বাঁইচা থাকবি?
হ্যাঁ, নানি। আমি বাঁইচা থাকমু।।
তখন নানি আমারে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ডোরা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল, আমি দেখলাম তার চোখ থেকে টপ টপ করে আমার মুখের ওপর পানি পড়ছে। ডোরা কাঁদছে। আহা বেচারি।
ডোরা ফিসফিস করে বলল, রঞ্জু! তোমার অনেক সাহস।
.
আমার সুস্থ হতে অনেক দিন লাগল। পিঠের ঘা শুকালেও সেখানে লম্বা লম্বা কাটা দাগ রয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত হাঁটাচলার মতো যখন একটু সুস্থ হয়েছি তখন একদিন গভীর রাতে নানি আমাকে ডেকে তুলল, ফিসফিস করে বলল, তোর সাথে একজন দেখা করতে আসছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার সাথে? এত রাত্রে?
হ্যাঁ।
কে?
জানি না।
বাতি জ্বালাও নানি, অন্ধকারে তো দেখা যাবে না।
বাতি জ্বালাইতে না করছে।
কেন বাতি জ্বালাইতে না করছে?
তখন অন্ধকার থেকে আমি মাসুদ ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম, মাসুদ ভাই বলল, এত রাতে বাতি জ্বালালে লোকজন সন্দেহ করবে। তোমার বাড়ির দিকে তো রাজাকারের নজর আছে, জানো না?
মাসুদ ভাই আপনি আসছেন?
আবছা অন্ধকারে মাসুদ ভাই এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখল, বলল, তুমি আমার জন্য খুব কষ্ট করলে রঞ্জু। এরকম ভয়ংকর একটা অত্যাচার হলো তোমার ওপর। আমার খুব খারাপ লাগছে।
আমি বললাম, না, মাসুদ ভাই, আপনার কী দোষ! একটু থেমে বললাম, মাসুদ ভাই।
বলো।
আমাকে এত অত্যাচার করলেও আমি কিন্তু আপনাদের একটা কথাও মিলিটারিকে বলি নাই।
মাসুদ ভাই অন্ধকারে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি জানি। সেই জন্য আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
সত্যি? আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, সত্যি মাসুদ ভাই?
হ্যাঁ, তোমার এখানে থাকা নিরাপদ না। মিলিটারিরা তোমাকে মারে নাই, বাঁচিয়ে রেখেছে। তোমাকে দরকার হলে আবার ক্যাম্পে নিবে। অত্যাচার করবে। আমি খবর পেয়েছি।
আমি মাসুদ ভাইয়ের কথা ভালো করে শুনলামই না। আনন্দে আবার চিৎকার করলাম।
আমাকে মুক্তিবাহিনীতে নেবেন?
মাসুদ ভাই বলল, তোমাকে মুক্তিবাহিনীতে নিতে হবে না তুমি এর মাঝে মুক্তিবাহিনীতে আছ! তোমাকে আমাদের ক্যাম্পে নেব।
আমি আবছা অন্ধকারে নানির দিকে তাকিয়ে বললাম, নানি, আমি মুক্তিবাহিনীতে যাব।
নানি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমার সাথে কথা বলছে। রাজাকাররা নাকি অপেক্ষা করতেছে একটু সুস্থ হলে তোরে আবার মিলিটারি ক্যাম্পে নেবে। এর থেকে এইটাই ভালো তুই এদের সাথে থাক। কথা শেষ করতে করতে নানি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমি নানিকে ধরে বললাম, নানি তুমি কাইন্দ না। আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসব।
মাসুদ ভাই বলল, একটু পরেই চাঁদ উঠে যাবে–তার আগে আমাদের গ্রাম থেকে বের হয়ে যেতে হবে। চল রঞ্জু।
আমার জামাকাপড় নিতে হবে না? বই-খাতা।
তাড়াতাড়ি নাও। দেরি করো না। অন্ধকারে যেটুকু পারো ততটুকু।
আমি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা ব্যাগে সবকিছু ভরে নিলাম, তারপর মাসুদ ভাইয়ের হাত ধরে ঘর থেকে বের হলাম। নানি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ফি আমানিল্লাহ। হেই খোদা ছেলেডারে আমি তোমার হাতে দিলাম, তুমি দেইখা রাখিও। তারপর কাঁদতে লাগল।
বাড়ির বাইরে দুইটা মুক্তিযোদ্ধা পাহারায় ছিল, তারা আমাদের সাথে সাথে হাঁটতে থাকে। আমরা সড়কে পা দিতেই হঠাৎ করে আমার ডোরার কথা মনে পড়ল, আমি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, কী হলো? দাঁড়ালে কেন?
মাসুদ ভাই, আমি একা একা মুক্তিবাহিনীতে যেতে পারব না। আমার আরেকজনকে নিয়ে যেতে হবে।
মাসুদ ভাই অবাক হয়ে বলল, আরেকজন? আরেকজন কে?
ডোরা।
ডোরা? ডোরা কে?
এখন তার নাম খোকন।
মাসুদ ভাই বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না রঞ্জু। তুমি কী বলছ পরিষ্কার করে বলো।
আমি মাসুদ ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ডোরা হচ্ছে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে মেরে ফেলেছে, তার মেয়ে। ডোরার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার এত শখ যে সে চুল কেটে ফেলেছে, এখন শার্ট-প্যান্ট পরে ছেলের মতো থাকে। তার এখন নূতন নাম খোকন।
ঠিক আছে, যখন সুযোগ পাবে ডোরাও নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
মাসুদ ভাই, আমি তাকে কথা দিয়েছি তাকে না নিয়ে আমি মুক্তিবাহিনীতে যাব না।
তাকে কথা দিয়েছ?
হ্যাঁ, মাসুদ ভাই তার গা ছুঁয়ে কথা দিয়েছি। তাকে না নিয়ে আমি যেতে পারব না।
মাসুদ ভাই আমার কথা শুনে খুব ঝামেলায় পড়ে গেল। সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, দেখো রঞ্জু, তোমাকে নিতে আসাটাই খুবই বিপজ্জনক একটা মিশন। এই জন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে আমি নিজে এসেছি। এখন সাথে আরেকজন ছোট মেয়েকে নেয়া তো খুব প্র্যাকটিকেল কথা না।
আমি খুব অনুনয় করে বললাম, কিন্তু মাসুদ ভাই আমি যে ডোরার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। এখন যদি তাকে না নিয়ে যাই তাহলে তো–
তাহলে কী?
তাহলে তো ডোরা মরে যাবে।
মরে যাবে?
হ্যাঁ।
মাসুদ ভাই খুব বিপদে পড়ে গেল। মাথা চুলকে বলল, তাহলে এখন কী করা যায়?
আমি বললাম, ডোরাকে না বলে আমি যেতে পারব না মাসুদ ভাই।
কখন বলবে?
এখন।
মাসুদ ভাই বলল, এখন? এই গভীর রাতে?
হ্যাঁ। এই তো সামনে তাদের বাড়ি। জানালার পাশে ঘুমায়। জানালায় টোকা দিলেই ঘুম থেকে উঠে যাবে। ডোরার ঘুম খুবই পাতলা। আমাকে বলেছে।
অন্ধকারে মাসুদ ভাইয়ের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তাই বুঝতে পারছিলাম না মাসুদ ভাই বিরক্ত হচ্ছে কি না। হলেও কিছু করার নেই, আমি ডোরার সামনে বিশ্বাসঘাতক হতে পারব না। মরে গেলেও না।