মিলিটারিটা খপ করে আমার ঘাড়টা ধরল, লোহার মতো শক্ত হাত, মনে হলো আমার ঘাড়ের ভেতর তার আঙুলগুলো ঢুকে গেছে। যখন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি তখন মেজর ইয়াকুব মিলিটারিটাকে আবার কিছু একটা বলল, কী বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হলো বলেছে। আমাকে টর্চার করে আমার ভেতর থেকে কথা বের করতে।
ক্লাস নাইন সেকশন ‘বি’টা হচ্ছে টর্চার সেল। বাইরে তালা লাগানো। বড় বড় গোঁফওয়ালা একজন তালা খুলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
ঘরের মাঝে কয়েকজন লোক পড়ে আছে, সারা শরীরে রক্ত শুকিয়ে আছে। মানুষগুলো বেঁচে আছে না মরে গেছে, বোঝা যাচ্ছে না। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে একজন বসে ছিল, আমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলল, হেই খোদা এই বাচ্চাটারে কেন আনছে।
বড় বড় গোঁফওয়ালা মানুষটা ধমক দিয়ে বলল খামোশ।
মানুষটা খামোশ হলো না, বলল, উসকো ছোড় দাও! আল্লাহর কসম। হামকো মারো। ইয়ে মাসুম বাচ্চা হয়।
খামোশ গাদ্দার। বলে গোঁফওয়ালা মানুষটা তাকে একটা লাথি দিল, মানুষটা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, পারে না। লাথি খেয়ে সে কাত হয়ে নিচে পড়ে গোঙাতে থাকে।
আমাকে বেঞ্চের ওপর উপুড় করে শুইয়ে বেঞ্চের পায়ার সাথে আমার হাত দুটি বেঁধে ফেলল। তারপর পা দুটি আলাদা করে বেঁধে নেয়। আমার বুকটা ধক ধক করছে। আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে ছিল মজনু। মাঝে মাঝেই তাকে স্যারদের হাতে ভয়ংকর মার খেতে হতো। সে আমাদের শিখিয়েছিল যখন বেত মারা হয় তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে হয় তাহলে নাকি ব্যথা কম লাগে। আমি কি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব? তাহলে সত্যিই কী ব্যথা কম লাগবে?
আমি টের পেলাম মিলিটারিটা আমার শার্টটা টেনে ওপরে তুলেছে, প্যান্টটা টেনে নিচে নামিয়ে এনেছে। তারপর দড়ির মতো কিছু একটা হাতে নিয়ে মানুষটা আমাকে মারল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, আমি চিৎকার থামাতে পারলাম না। আমার সেই চিৎকারে সারা পৃথিবীটা নিশ্চয়ই টুকরা টুকরা হয়ে গেল।
আমি কতক্ষণ চিৎকার করেছি, জানি না। কিছুক্ষণ পর আমার আর কিছু মনে নাই। আমি নিশ্চয়ই মরে গেছি।
.
১৯.
একটু পর পর আমার ঘাড়ে কেউ যেন খোঁচা দিচ্ছে, আমি হাত দিয়ে খোঁচাটা থামাতে গেলাম তখন একটা পাখা ঝটপটানোর শব্দ শুনতে পেলাম। কিছু একটা আমার কাছ থেকে উড়ে গেল। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, মনে হলো বহুদূরে একটা নদী। আমি কোথায়?
আমি চারপাশে দেখার চেষ্টা করতেই শরীরের কোথায় জানি প্রচণ্ড ব্যথা করে উঠল। আমি যন্ত্রণার শব্দ করে খানিকক্ষণ ঝিম ধরে শুয়ে থাকলাম। তাহলে আমি কি বেঁচে আছি? বেঁচে থাকলে আমি কোথায় আছি? মিলিটারির ক্যাম্পে নাকি অন্য কোথাও?
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম। কয়েকটা কাক একটু দূরে বসে আমাকে লক্ষ্য করছে। এরাই মনে হয় ঘাড়ে ঠোকর দিচ্ছিল। কাঁকনডুবিতে কোনো কাক ছিল না। কাক নাকি শুধু নোংরা জিনিস খায়, মরা জিনিস খায়, তাই কাঁকনডুবিতে তাদের কোনো খাদ্য-খাবার ছিল না। এখন কাঁকনডুবিতে অনেক মরা মানুষ। তাদের অনেক খাবার। আমাকে মরা মনে করে কাকেরা খেতে এসেছিল। একটু পরে মনে হয় কুকুরগুলো আসবে, কাকের মতো এত সহজে সরে যাবে না। আমি বেঁচে থাকলেও তারা ছিঁড়ে-খুঁড়ে আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমার মনে হয় উঠে বসার চেষ্টা করা উচিত। আমি একটু চেষ্টা করতেই শরীরের কোথায় জানি ভয়ংকর ব্যথা করে উঠল। আমি আবার যন্ত্রণার শব্দ করে শুয়ে থাকলাম। আবার আমি অচেতন হয়ে যাচ্ছি। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো আসলে আর কিছুতে কিছু আসে যায় না। বেঁচে থাকলেই কী আর মরে গেলেই কী। মনে হয় মরে গেলেই ভালো। বাবা আর মায়ের সাথে দেখা হবে কোনো দিন দেখি নাই। দেখা হলে কি চিনতে পারব? আমি কী বলব তাদেরকে?
ঠিক তখন মনে হলো কেউ একজন বলল, ইয়া মাবুদ! এইখানে এইটা কে?
তারপর ধুপ ধুপ পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ একজন আমার কাছে এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে বলল, বেঁচে আছে। মরে নাই। বাচ্চা ছেলে।
আরেকজন বলল, এইটা রঞ্জু না? কালকে রাজাকাররা এরে ধরে নিল না?
মানুষ দুইজন আমাকে ধরাধরি করে তুলে নিল, শরীরের ভেতর আবার কোথায় জানি ভয়ংকর যন্ত্রণা করে উঠল। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
.
আমার আবার যখন জ্ঞান হলো তখন আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে অনেক মানুষ, তারা কথা বলছে, একটা ছোট ছেলে আমার হাত ধরে বসে আছে। ছেলেটা কে? একটু পরে আমি ছেলেটাকে চিনতে পারলাম। ছেলেটা খোকন, চুল কাটা, শার্ট-প্যান্ট পরা ডোরা। আমি চোখ খুলতেই ডোরা চিৎকার করে বলল, চোখ খুলেছে। চোখ খুলেছে।
আমার ওপরে অনেকে ঝুঁকে পড়ল, নানির মুখটা দেখতে পেলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইডি! বাঁইচা আছস?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, নানি।
বাঁইচা থাকবি? আল্লাহর কসম, তুই বল তুই বাঁইচা থাকবি! বল। বল তুই আমারে ছাইড়া যাবি না।
আমি বললাম, আমি তোমারে ছাইড়া কই যামু নানি।