স্কুলের গেটে বালুর বস্তা দিয়ে ঘেরাও করে মিলিটারিরা পাহারা বসিয়েছে। ওপরে সাইনবোর্ডে বড় করে আমাদের স্কুলের নাম নবকুমার হাই স্কুল লেখা ছিল। আলকাতরা দিয়ে সেটা মুছে সেখানে লেখা হয়েছে গাঁজালা ইয়াকুব হাই স্কুল। হিন্দু নাম সরিয়ে মুসলমান নাম। গাজালা ইয়াকুব মানুষটা কে? মনে হয় মেজর ইয়াকুবের বাবা কিংবা মা।
স্কুলের ভেতর ঢুকে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, এটা যে আমাদের স্কুল ছিল বোঝার কোনো উপায় নাই। স্কুলের ভেতরে কত গাছ ছিল, এখন কোনো গাছ নাই, কেমন জানি ন্যাড়া লাগছে। জায়গায় জায়গায় তাঁবু খাটিয়েছে। তেরপল টানিয়ে নিচে বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। পানির ড্রামে মিলিটারিগুলো খালি গায়ে গোসল করছে। এই মাথা ওই মাথা দড়ি টানানো সেইখানে কাপড়ও ধুয়ে শুকাতে দিয়েছে। স্কুলের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা বাঁশ পুঁতে তার আগায় একটা পাকিস্তানের পতাকা টানিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানের পতাকা দেখতে যে এত ভয়ংকর সেটা আমি আগে কখনো বুঝতে পারি নাই।
রাজাকারগুলো হেডমাস্টারের রুমের সামনে দাঁড়াল। মনে হয় এখন এই রুমটা মেজর ইয়াকুবের রুম। দরজার কাছে একটা মিলিটারি পাহারা দিচ্ছিল, রাজাকারগুলোর সাথে আমাকে দেখে সে ভেতরে ঢুকে কিছু একটা বলল, তখন আমি মেজরের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আন্দার লে আও।
রাজাকারগুলো আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। আমাদের হেডমাস্টারের রুমটা এখন চেনা যায় না। এক পাশে আলমারি ছিল, আলমারিতে বই ছিল, ফুটবল খেলায় জিতে আমরা যে ট্রফি পেয়েছিলাম, সেগুলো ছিল, এখন তার কিছু নাই। বড় টেবিলের পাশে একটা ছোট টেবিল, সেই টেবিলের ওপর একটা পিস্তল। পাশে একটা বোতল, পাশে কয়েকটা গ্লাস। আমি আগে কখনো মদের বোতল দেখি নাই কিন্তু মনে হলো এইটা নিশ্চয়ই মদের বোতল।
মেজর ইয়াকুব সবাইকে চলে যেতে বলল, তখন একজন একজন করে সবাই বের হয়ে গেল। মেজর ইয়াকুব একটা সিগারেট ধরিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ক্যায়া, ডর লাগতি হু?
আমি ভয় পেয়েছি কি না জানতে চেয়েছে। আস্তে আস্তে আমার ভয় লাগতে শুরু করেছে। আমি তাই মাথা নেড়ে জানালাম যে আসলেই আমার ভয় লাগছে।
মেজর ইয়াকুব হাসার মতো ভঙ্গি করল, তারপর বাংলা বলার চেষ্টা করল, বয় নাই। কুনু বয় নাই।
কী কারণ জানি না, মেজর ইয়াকুবের মুখে এই বাংলা শুনে আমার হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। মেজর ইয়াকুব তার পা দুইটা টেবিলে তুলে দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। আধা বাংলা আধা উর্দুতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই স্কুলে পড়ো?
আমি মাথা নাড়লাম।
এই স্কুলে মাসুদ আহমেদ নামে একজন শিক্ষক পড়াত তুমি তাকে চিনো?
আমি এক মুহূর্ত চিন্তা করলাম, চিন্তা করে মাথা নেড়ে জানালাম যে চিনি।
তার সাথে তোমার যোগাযোগ আছে?
আমার হঠাৎ করে গলা শুকিয়ে গেল, বললাম, নাই।
মেজর ইয়াকুবের মুখ শক্ত হয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না। আমরা জানি যেদিন তোমার শিক্ষক মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে এসেছে সেদিন তুমি তার সাথে দেখা করেছ। তুমি তার সাথে কথা বলেছ।
আমি চমকে উঠলাম। মেজর ইয়াকুব হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, কী নিয়ে কথা বলেছ?
আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই আমাকে বলতে না করেছে আমি কাউকে বলতে পারব না। আমাকে মেরে ফেললেও বলব না।
মেজর ইয়াকুব টেবিল থেকে তার পা নামিয়ে আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে বলল, তার দলে কতজন আছে, কী কী অস্ত্র? কোথায় থাকে তুমি জানো?
আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে আমি জানি না। মেজর ইয়াকুব টেবিলে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল। কালকে আমি তোমাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলেছিলাম, তুমি বলো নাই। কেন বলো নাই?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। কী উত্তর দেব? মেজর ইয়াকুব বলল, আমি বলি, তুমি কেন বলো নাই? তুমি বলো নাই তার কারণ তুমিও আসলে মুক্তিবাহিনী! তোমার মতো বাচ্চা ছেলেদেরও ব্রেন ওয়াশ করা হয়ে গেছে। বুঝেছ?
আমি কিছু বললাম না। তু
মি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। বলো।
আমি বললাম, আমি কিছু জানি না।
তুমি যদি উত্তর না দাও তাহলে তোমার মুখ থেকে আমি জোর করে উত্তর বের করব। তুমি বাচ্চা দেখে আমি ছেড়ে দেব না। এই বাঙালি হচ্ছে জারজ সন্তানের জাতি। এদের বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নাই। ছোট-বড় কাউকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নাই।
আমি ভয় পাওয়া চোখে মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব বলল, ম্যায় ইস মুলককা সেরফ জমিন চাতা হু। লোক নেহি। আমি এই দেশের খালি মাটি চাই, মানুষ চাই না।
আমার গলা শুকিয়ে গেল, বুক কাঁপতে লাগল। একবার মনে হলো যা জানতে চেয়েছে বলে দিই। তারপরেই মাথা থেকে সেই চিন্তা সরিয়ে দিলাম, আমি মাসুদ ভাইকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না। আমাকে কথা রাখতে হবে। আমি পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না।
মেজর ইয়াকুব উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে গ্লাসে পানির মতো একটা তরল ঢালল, সাথে সাথে ঘরের ভেতর ঝাঁঝাল টক টক একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। এক টোকে গ্লাসের পুরো তরলটা খেয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে ডাকল, সরফরাজ।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভেতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেজর ইয়াকুব বলল, ইসকে টর্চার সেল মে লে যাও।