সেদিন বিকেলে স্কুল ছুটির পর আমি আর মামুন যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছি তখন আবার বলাই কাকুর চায়ের স্টলে দাঁড়ালাম। চায়ের স্টলে আজকে কেউ নাই, শুধু বলাই কাকু বসে বসে তার রেডিও শুনছেন। রেডিওতে উর্দুতে একজন মানুষ খবর পড়ছে। উর্দুতে কী বলে আমরা তার একটা-দুইটা শব্দ বুঝতে পারি। মাগরেবে পাকিস্তান মানে পশ্চিম পাকিস্তান, মাশরেকে পাকিস্তান মানে পূর্ব পাকিস্তান। যখন পূর্ব পাকিস্তানে দুইটা বাজে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে একটা বাজে। কী আজ একটা ব্যাপার। একটা দেশের দুইটা অংশ একেকটা অংশে একেকটা সময়। দুই অংশেই এক সময় করে দিলে ক্ষতি কী ছিল? মাসুদ ভাইকে একদিন এই প্রশ্নটা করতে হবে।
বলাই কাকু আমাদের দুইজনকে দেখে বললেন, তোমাদের লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?
বলাই কাকু আমাদের দেখলে সব সময় লেখাপড়ার খোঁজ নেন। আমরা বললাম, ভালো।
বলাই কাকু বললেন, হ্যাঁ। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদণ্ড। বুঝেছ?
আমরা মাথা নাড়লাম। বলাই কাকু এর পরে কী বলবেন–সেটাও আমরা জানি, বলবেন, লেখাপড়া করে যেই গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সেই। সত্যি সত্যি সেটা বললেন, আমরা তখন আবার মাথা নেড়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম–ফ্রি চা খেতে দেন কি না দেখার জন্য।
বলাই কাকুর মনে হয় ফ্রি চা দেবার কথা মনে নেই, ঘোট ঘোট কাঁচের গ্লাসগুলো পানিতে ধুতে ধুতে অন্যমনস্কভাবে রেডিও শুনতে লাগলেন। শুনতে শুনতে বললেন, মনে হয় না ক্ষমতা দেবে।
কে কাকে ক্ষমতা দেবে আমরা বুঝতে পারলাম না। মনে হয় রাজনীতির কোনো কথা বলছেন। ইলেকশনের পরে সবাই এখন রাজনীতির কথা বলে। মামুন জিজ্ঞেস করল, কাকে ক্ষমতা দেবে না বলাই কাকু?
শেখ সাহেবকে। ইয়াহিয়া খান মনে হয় না শেখ সাহবকে ক্ষমতা দেবে।
দেশে কী হচ্ছে আমরা কিছুই জানি না, তাই বুঝতে পারলাম না। কেন ইয়াহিয়া খান শেখ সাহেবকে ক্ষমতা দেবে না। মামুন আমার থেকে বেশি খোঁজখবর রাখে, সে বলল, ইয়াহিয়া খান মানুষ ভালো না। আইয়ুব খান হলে নিশ্চয়ই শেখ সাহেবকে ক্ষমতা দিয়ে দিত। তাই না বলাই কাকু?
বলাই কাকুর আইয়ুব খানের ওপরও খুব ভরসা আছে বলে মনে হলো না, অনিশ্চিতের মতো বললেন, কী জানি বাপু! আমি পাঞ্জাবিদের কাজকর্ম বুঝি না। যারা ভাত না খেয়ে রুটি খায়, তাদের বুদ্ধি আর কত হবে?
আমি আর মামুন একসাথে মাথা নাড়লাম, কথাটা সত্যি, যারা ভাত খেয়ে না রুটি খেয়ে থাকে তাদের বুদ্ধি খুব বেশি হবার কথা না, তাদের কাজকর্মে বোকামি থাকতেই পারে।
বলাই কাকু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সারা দেশে কী হচ্ছে কোনো খোঁজ পাই না। খুবই অস্থির লাগে।
তার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, সেটা শুনে আমি আর মামুন দুজনেই একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মামুন জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে বলাই কাকু?
শেখ সাহেব এতগুলো সিট পেয়েছে এখন তারে যদি ক্ষমতা না দেয় তাহলে বাঙালিরা কি বসে থাকবে? কিছু একটা গোলমাল শুরু হবে না?
মামুন সবকিছু বুঝে ফেলেছে এ রকম একটা ভঙ্গি করে বলল, বলাই কাকু, গোলমাল হলেও তো আমাদের কাঁকনডুবিতে কখনো গোলমাল হবে না! সব গোলমাল হয় ঢাকায়।
তা ঠিক।
আমাদের কোনো ভয় নাই। আছে বলাই কাকু?
মনে হয় নাই।
বলাই কাকুর সাথে রাজনীতির আলাপ করে আমরা যখন চলে আসছি তখন তার ফ্রি চায়ের কথা মনে পড়ল। আমাদের ডেকে কাঁচের গ্লাসে করে আধ কাপ চা বানিয়ে দিলেন, সাথে একটা কুকি বিস্কুট।
আমরা খুব তৃপ্তি করে চা-বিস্কুট খেলাম। খেতে খেতে আমি মামুনের সাথে রাজনীতির আলাপ করার চেষ্টা করলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দেবে না–আইয়ুব খান হলে দিত তার কারণটা কী মামুন?
মামুন তার চায়ের গ্লাসের শেষ ফেঁটাটা খুব তৃপ্তি করে খেতে খেতে বলল, আইয়ুব খান হচ্ছে বাঘের বাচ্চা! কী চেহারা। আর ইয়াহিয়া খানের ছবি দেখেছিস?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, দেখি নাই।
ইয়াহিয়া খানের চেহারা একেবারে জানোয়ারের চেহারা। যেই মানুষের চেহারা জানোয়ারের মতো তার কাজকর্ম সবকিছু জানোয়ারের মতো।
এইটাই কারণ?
মামুন মাথা নাড়ল, বলল, এইটাই আসল কারণ।
.
মাসুদ ভাই অবশ্যি চেহারাটা আসল কারণ, সেটা বলল না। আমি যখন ক্লাসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম মাসুদ ভাই একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কারণটা এত সোজা না। এর কারণটা বুঝতে হলে অনেক কিছু বুঝতে হবে।
কী বুঝতে হবে, মাসুদ ভাই?
এইখানে আসলে তিনটা আলাদা আলাদা দেশ হওয়ার কথা ছিল। বাঙালিদের একটা দেশ, পাঞ্জাবিদের একটা দেশ আর ইন্ডিয়া। বাঙালিদের আলাদা দেশটা দেয় নাই–সেইটা পাকিস্তানের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে।
আমরা বিষয়টা বুঝে ফেলেছি সেইভাবে মাথা নাড়লাম।
পাকিস্তান হওয়ার পর কী হলো? মার্শাল ল-এর পর মার্শাল ল।
একজন জিজ্ঞেস করল, মার্শাল ল মানে কী?
মিলিটারি শাসন। খুব খারাপ জিনিস। আইয়ুব খানই বারো বছর ক্ষমতায় থাকল। দেশটারও বারোটা বাজিয়ে দিল।
মামুনকে একটু বিমর্ষ দেখলাম সে আইয়ুব খান, বিশেষ করে তার চেহারার, খুব ভক্ত।
মাসুদ ভাই বলতে থাকল, সংখ্যায় আমরা বেশি কিন্তু শাসন করে পাঞ্জাবিরা। পূর্ব পাকিস্তানকে চুষে চুষে খায়। আমাদের চাষিরা কত কষ্ট করে পাট চাষ করে সেই পাট বেচে যে টাকা আসে সেই টাকা নিয়ে যায় পাঞ্জাবিরা, উন্নতি হয় পশ্চিম পাকিস্তানের। যে-ই প্রতিবাদ করে তাকেই জেলখানায় আটকে রাখে। কী অত্যাচার চিন্তা করতে পারবে না।