কী কথা।
আগে বল আমার কথাটা রাখবি।
কথাটা আগে শুনি।
ডোরা মাথা নাড়ল। বলল, না, আগে কথা দে।
ঠিক আছে কথা দিলাম। এখন বল, কী কথা।
ডোরা মুখ গম্ভীর করে বলল, তুই আমাকে ছাড়া কখনো একা একা মুক্তিবাহিনীতে যাবি না।
আমি শব্দ করে হাসলাম, বললাম, মুক্তিবাহিনী কি আমাকে নেবে? যখনই মাসুদ ভাইকে বলি তখনই মাসুদ ভাই বলে তুমি ছোট, তুমি ছোট।
ডোরা হাসল না, মুখ শক্ত করে বলল, আমি সেটা জানি না। কিন্তু তুই কথা দে, আমাকে না নিয়ে তুই একা কখনো মুক্তিবাহিনীতে যাবি না।
আমি বললাম, কথা দিলাম।
আমাকে ছুঁয়ে কথা দে।
আমি ডোরার হাত ছুঁয়ে বললাম, কথা দিলাম।
.
ডোরাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন যাচ্ছি তখন হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সড়ক ধরে মিলিটারি আর রাজাকারের একটা দল আসছে। আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি সড়ক থেকে সরে পাশে এসে দাঁড়ালাম।
বৃষ্টি কমেছে বলে অনেকেই কাজকর্ম করার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছে, সড়কে কিছু লোকজন ছিল তারা সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে সড়ক থেকে সরে রাজাকার আর মিলিটারিদের যাবার জায়গা করে দিল।
কিছু মানুষকে দেখে মিলিটারিগুলো দাঁড়িয়ে গেল, তখন আমি একজনকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করলাম। সে নিশ্চয়ই মেজর ইয়াকুব, কারণ অন্যেরা তার থেকে একটু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। মেজর ইয়াকুব মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করলে, কেয়া হাল হায়? আচ্ছে হোনা?
মানুষগুলো মাথা নাড়ল।
তোম কেয়া মুক্তি হো? না কেয়া পাকিস্তানি হো?
আমাদের গ্রামের মানুষেরা উর্দু জানে না কিন্তু প্রশ্নটা ঠিকই বুঝতে পারল। জিজ্ঞেস করছে তারা কি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে, নাকি পাকিস্তানের পক্ষে। মানুষগুলো বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, যার অর্থ যা কিছু হতে পারে। মেজর ইয়াকুব তখন বলল, বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মানুষগুলো অস্পষ্ট স্বরে বলল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মেজর ইয়াকুব তখন খুব খুশি হয়ে তার দলবল নিয়ে হাঁটতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম আমাকে কোনো পাত্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু মেজর ইয়াকুব হঠাৎ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মেরা বেটা, তোম ক্যোয়সা হো।
আমি কেমন আছি জানতে চাচ্ছে। ছোট হওয়ার একটা সুবিধা আছে, কিছু বুঝি নাই এ রকম ভান করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা যায়। আমি তা-ই করলাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
মেজর ইয়াকুব বলল, কেয়া! তোম মুক্তি হয় না?
বলা উচিত ছিল তোমরা কয়জন ছাড়া এই দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এটা তো আর বলা যায় না। তাই চুপ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব তখন বলল, বেটা, বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
এই কথাটা বুঝতে পারি নাই সেটা ভান করে লাভ নাই। যে কেউ এই কথাটা বুঝবে। কিন্তু আমি কেমন করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলি? বুঝে হোক না বুঝে হোক আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব কেমন জানি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, বোলো বেটা।
আমি বললাম না।
বোলো। বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
আমার মাথায় কী হলো আমি জানি না, আমি চুপ করে রইলাম, শুধু যে চুপ করে রইলাম তা না, আমি সোজা মেজর ইয়াকুবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি দেখলাম, মেজর ইয়াকুবের চোখ ধক ধক করে জ্বলে উঠল। একটা রাজাকার রাইফেলের বাঁট দিকে দিয়ে আমাকে মারার জন্য এগিয়ে এল। মেজর ইয়াকুব হাত বাড়িয়ে তাকে থামাল, নিচু গলায় বলল, ছোড় দো। লেট ইট গো।
তারপর পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি হাত বাড়িয়ে লজেন্সটা নিলাম। মেজর ইয়াকুব একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করল। রাজাকার আর মিলিটারিগুলো আমার সামনে থেকে একটু সরে যেতেই আমি লজেন্সটা সড়কের নিচে ছুড়ে ফেলে দিলাম। পাকিস্তানি মিলিটারির হাতের লজেন্স খাওয়ার আগে আমার মরে যাওয়া ভালো।
.
পরদিন দুপুরবেলা রাজাকারের একটা দল আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেল। নানি কিছুতেই নিতে দেবে না, চিৎকার করে আমাকে শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু রাজাকাররা ধাক্কা দিয়ে নানিকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে টেনে নিতে লাগল।
আমাকে যখন টেনে সড়ক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন নানি চিৎকার করতে করতে বিলাপ করে আমার পেছনে পেছনে ছুটে আসছিল, একসময় গ্রামের লোকজন তাকে ধরে সরিয়ে নিয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি লতিফা বুবুকেও দেখলাম। ডোরা নিশ্চয়ই খবর পায় নাই, তাই তাকে দেখলাম না। গ্রামের একজন মুরব্বি রাজাকারদের থামিয়ে আমাকে ছুটিয়ে নিতে চেষ্টা করল, বলল, বাবারা, এই মাসুম বাচ্চাটারে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ?
মেজর সাহেবের অর্ডার।
গিয়া বল, পোলাটা বাড়িতে নাই। খুঁজে পাও নাই।
না না, মিছা কথা বলা যাবে না।
বাবা, এই ক্যাম্পে যারা ঢুকে তারা তো কখনো জ্যান্ত বের হয় নাই।
একজন রাজাকার বলল, সেইটা আমাদের বিষয় না।
আরেকজন বলল, এত চিন্তা করেন কেন? দুই-চাইরটা চড়-থাপ্পর দিয়া তো ছাইড়াও দিতে পারে।
মুরব্বি বলল, আল্লাহর কসম লাগে। বাপ-মা মরা এতিম ছাওয়ালটাকে ছাইড়া দেও।
রাজাকারগুলো মুরব্বিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক কী কারণ জানা নাই, আমার কেন জানি খুব বেশি ভয় লাগছিল না। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আমি চিন্তা করতে পারছিলাম, মানুষ যখন ঠিক করে চিন্তা করতে পারে না, তখন মনে হয় ভয় পায় না। আনন্দ কিংবা দুঃখও পায় না।