মাসুদ ভাই বলল, বলো, তোমাদের কী নিয়ে উৎসাহ দেব?
আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, এই ভাবে যে উৎসাহ দেওয়ার জন্য একটা বিষয় ঠিক করে দেওয়া যায়, সেইটাও জানতাম না। লেখাপড়া করতে কারোরই ভালো লাগে না, সেটা বলা যায় কিন্তু সেটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারলাম না–লেখাপড়া নিয়ে কথাবার্তা যত কম হয় ততই ভালো। এর মাঝে মামুন দাঁড়িয়ে গেল, বলল, আমাদের এই গ্রামটার অবস্থা খুবই খারাপ, এইখানে কিছু নাই। থাকার ইচ্ছা করে না।
মাসুদ ভাই নামের মানুষটা চোখ কপালে তুলে বলল, বলো কী? এই গ্রামে কিছু নাই? একটা ভরা নদীর পাশে একটা ছোট ছবির মতো গ্রাম! এত সুন্দর একটা স্কুল। কিছু নাই মানে?
আমরা আবার একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম! সুন্দর স্কুল? স্কুলের কোন জায়গাটা সুন্দর?
মাসুদ ভাই বলল, আমাদের দেশে আর কয়টা ভালো স্কুল আছে? এ রকম গ্রামের মাঝে বিশাল একটা স্কুল। আশপাশের দশ গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে লেখাপড়া করতে আসে। তোমরা যে এই নবকুমার হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রী, সেইটা নিয়ে গর্ব হওয়া উচিত।
গর্ব হওয়া উচিত কি না বুঝতে পারলাম না, তবে এটা সত্যি কথা আশপাশের সব গ্রামের ছেলেমেয়েরা এই স্কুলে পড়তে আসে। আমাদের স্কুলের পাকা দালান, সামনে বড় মাঠ, পাশে বিশাল দিঘি। এই এলাকায় আর কোথাও পাকা দালান নাই।
মাসুদ ভাই বলতে থাকল, শুধু কি তাই! তোমাদের গ্রামের নামটা কী সুন্দর। কাঁকনডুবি। কোনো দিন চিন্তা করেছ নামটা কোথা থেকে এসেছে?
মামুন আবার তার ফিচলে বুদ্ধি দিয়ে চেষ্টা করল, বলল, মনে হয় অনেক কাক ছিল–
মাসুদ ভাই দুই হাত নেড়ে বলল, না না না। কাঁকনডুবি নাম মোটেও কাক থেকে আসেনি। এসেছে কাঁকন মানে হাতের চুড়ি থেকে। নিশ্চয়ই এখানে একদিন কোনো একজন রাজকন্যা ছিল, সে কোনো একটা বড় দিঘিতে গোসল করতে নেমেছে তখন হাত থেকে কাঁকনটা খুলে ডুবে গেছে। সেই থেকে এই গ্রামের নাম কাঁকনডুবি।
আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, রাজকন্যা কোথা থেকে এল?
হয়তো এখানেই রাজার বাড়ি ছিল। সেখানে রাজা থাকত, রানি থাকত, রাজপুত্র-রাজকন্যা থাকত। তোমাদের গ্রামের উত্তরে যে বিশাল জঙ্গল সেখানে কোথাও হয়তো সেই রাজার প্রাসাদ মাটির নিচে লুকিয়ে আছে। কে বলবে?
মাসুদ ভাই এমনভাবে বলল যে আমার মনে হলো সত্যিই বুঝি আমাদের গ্রামের পেছনে জঙ্গলের ভেতরে কোথাও একটা রাজপ্রাসাদ আছে, গাছপালায় ঢেকে আছে কিন্তু ভেতরে অনেক রহস্য।
ঠিক তখন একটা খুবই আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমাদের ক্লাসে যে মেয়েরা আছে তাদের একজন হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, বলল, স্যার।
মেয়েরা ক্লাসে কখনোই কোনো কথা বলে না, আমরা তাদের সবার নাম পর্যন্ত জানি না। এই বছর শেষ হবার পর এদের অর্ধেকই স্কুলে আসা বন্ধ করে দেবে। সে রকম একটা মেয়ে নিজ থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকালাম। এই মেয়েটার নাম নীলিমা, হিন্দুপাড়ায় থাকে।
মাসুদ ভাই মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। স্যার না। বলো মাসুদ ভাই–
মেয়েটা লজ্জায় লাল-নীল-বেগুনি হয়ে গেল, তার পরও সাহস করে বলল, মাসুদ ভাই। মেয়েরা যখন দিঘিতে স্নান করে তাদের হাতের কাঁকন তো এমনি এমনি খুলে যায় না!
মাসুদ ভাই বলল, অবশ্যই খুলে যায় না। তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু হয়তো মেয়েটি ছোট একটি মেয়ে ছিল, শখ করে তার মায়ের কাঁকন পরেছিল। ঢলঢলে কাঁকন হাত থেকে খুলে গিয়েছিল। কিংবা কিংবা মাসুদ ভাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, হয়তো মেয়েটার খুব অসুখ করেছিল শুকিয়ে কাঠি হয়ে গিয়েছিল, হাতের কাঁকন ঢলঢলে হয়ে গিয়েছিল, সুন্দর একটা দিঘির টলটলে পানি দেখে মেয়েটার সেই পানিতে স্নান করার ইচ্ছে করল। কে বলবে? কত কী হতে পারে। তোমরা কল্পনা করে নাও।
মামুন আমাকে ফিসফিস করে বলল, মাথায় গোলমাল আছে মনে হয়।
আমি কিছু বললাম না, মাথায় গোলমাল থাকলে থাকুক–কথাগুলো তো শুনতে ভালোই লাগে।
মাসুদ ভাই বলল, কল্পনা খুব বড় জিনিস। তুমি যত বেশি কল্পনা করবে তোমার পৃথিবীটা হবে তত বড়। তোমার যেটা নাই, তুমি কল্পনায় সেটা ইচ্ছা করলেই পেয়ে যেতে পারবে।
মামুন আবার তিড়িং করে লাফ দিল, বলল, না মাসুদ ভাই। এটা ঠিক না! ধরেন আপনার খুব খিদা লাগছে, তখন যদি আপনি কল্পনা করেন আপনি কোরমা-পোলাও খাচ্ছেন তাহলে কি লাভ হবে? খিদা তো কমবে না–
আর যদি কল্পনা না করো, তাহলে কি খিদে কমবে?
মামুন ইতস্তত করে বলল, না—তা–কমবে না।
তাহলে? খিদে কমানোর জন্য তোমাকে খাবার খুঁজে পেতে আনতে হবে, খেতে হবে। সেটা তো আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তোমাকে কল্পনা করতে হবে। যদি কোরমা-পোলাও খাওয়ার কথা কল্পনা করো, তাহলে একদিন হয়তো কোরমা-পোলাও খাবে। তা না হলে সারা জীবন শুঁটকি ভর্তা খেতে হবে। প্রথমে কল্পনা করবে তারপর একদিন সেই কল্পনা সত্যি হবে। এটা আমার কথা না। এটা অনেক বড় মানুষের কথা।
কথা বলতে বলতে মাসুদ ভাই জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, আমি দেখলাম তার চোখটা জানি কেমন টুলু ঢুলু হয়ে গেল। মাসুদ ভাইয়ের নিশ্চয়ই কিছু একটা কল্পনা আছে, একদিন তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে তার কল্পনাটা কী। আর কল্পনার এই কথাটা কোন বড় মানুষ বলেছে। তার নামটাও জিজ্ঞেস করতে হবে। মাসুদ ভাই নামের মানুষটাকে আমার খুব পছন্দ হলো। মামুন যদিও মাথা নেড়ে আমাকে ফিসফিস করে বলছে, পাগল! বদ্ধ পাগল। কিন্তু আমি জানি মানুষটাকে মামুনেরও পছন্দ হয়েছে। মনে হয় সবারই পছন্দ হয়েছে।