কী কথাটা আমার মনে রাখতে হবে আমি জানি, তার পরেও আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী কথা?
তুই কালী গাং থেকে দূরে থাকবি। সব সময় কমপক্ষে একশ হাত দূরে থাকবি। কালী গাংয়ের পানিতে নামবি না, গাংয়ের পাড়েও যাবি না।
কেন আমার কালী গাংয়ের কাছে যাওয়া নিষেধ, সেটাও আমি নানির কাছে অনেকবার শুনেছি। তার পরও আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন নানি?
কালী গাং হচ্ছে রাক্ষুসী। তোর বাপরে খাইছে, মারে খাইছে, তোরেও খাইতে চায়। তার পানিতে নামলে তোরে খপ করে ধরে পানিতে ডুবায়া দিব, তোরে ছাড়ব না এই রাক্ষুসী তোরে ছাড়ব না–
নানির কথা শুনে আমার কেমন জানি গা শিরশির করে, মনে হয় সত্যিই বুঝি কালী গাং একটা নদী না–একটা রাক্ষুসী–আমার দিকে তাকিয়ে আছে! কিন্তু আমি অবশ্যি কালী গাংকে ভয় পাই না, অন্যদের সাথে কালী গাংয়ে লাফ দিই, শীতের সময় যখন পানি কম থাকে তখন সাঁতার দিয়ে পার হয়ে যাই। বর্ষার সময় যখন পানির খুব স্রোত থাকে, ঘোলা পানি নদীর মাঝখানে পাক খেতে থাকে, তখন অবশ্যি কোনো দিন পার হবার চেষ্টা করি নাই। কোনো এক বর্ষায় সেইটা করতে হবে। নানি অবশ্যি এগুলো কিছুই জানে না। জানার দরকার কী?
.
০২.
টিফিন ছুটির আগে ব্যাটারি স্যারের ক্লাস। এই স্কুলে সব স্যারদের একটা করে নাম আছে। নামগুলো কে দেয়, কেউ জানে না কিন্তু কীভাবে কীভাবে জানি ছাত্রছাত্রীদের কাছে আসল নামটা চাপা পড়ে যায়। যেমন ব্যাটারি স্যারের নামটা ব্যাটারি তার কারণ স্যার দেখতে ব্যাটারির মতো, খাটো গোল শরীর তার ওপর ছোট মাথা, কোনো ঘাড় নাই। ধর্ম স্যারের শুকনো শরীর, লম্বা গলা, মাথায় আরো লম্বা টুপি, তার নাম বোগলা স্যার। বকের সাথে মিল তাই বোগলা স্যার! ইংরেজি স্যারের তেলতেলে ফর্সা চেহারা ছোট ছোট নিষ্ঠুর চোখ, হাতে বেত নিয়ে ক্লাসে ঢোকেন, কথায় কথায় বলেন, ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দেব তাই তার নাম ডাণ্ডি স্যার। গায়ের রং কালো বলে বাংলা স্যারের নাম কাউলা স্যার। থুতনিতে ছাগলের মতো দাড়ি বলে উর্দু স্যারের নাম ছাগলা স্যার।
যাই হোক, আমরা যখন ব্যাটারি স্যারের জন্য অপেক্ষা করছি তখন খুবই বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল, ব্যাটারি স্যারের বদলে ক্লাসে ঢুকলেন টিবি স্যার (স্কুলের হেডমাস্টার কিন্তু যক্ষ্মা রোগীর মতো শুকনো বলে নাম টিবি স্যার) কিন্তু সেটা বিচিত্র না কারণ তার পিছু পিছু ক্লাসে ঢুকল কমবয়সী একজন মানুষ, শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে চশমা। আমি আর মামুন মানুষটাকে চিনে গেলাম, গতকাল বলাই কাকুর চায়ের স্টলে এই মানুষটা হাত-পা নেড়ে রাজনীতির কথা বলছিল।
টিবি স্যার চশমা পরা মানুষটাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেই আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, স্যার হাত নেড়ে আমাদের বসার ইঙ্গিত করলেন, আমরা তখন বসে গেলাম। টিবি স্যার একটু কেশে বললেন, তোমাদের মজিদ স্যারের অসুখ, কিছুদিন ছুটি নিয়েছেন (আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, এখন মনে পড়ল ব্যাটারি স্যারের আসল নাম আব্দুল মজিদ)। যে কয় দিন ছুটিতে আছেন তোমাদের বিজ্ঞানের ক্লাস নেবার জন্য আমি মাসুদকে অনুরোধ করেছি, মাসুদ পিকে, কলেজে বিএসসি পড়ে (টিবি স্যার অবশ্যি বিএসসি বললেন না, উচ্চারণ করলেন বি.এচ.চি) সে খুবই মেরিটরিয়াস ছাত্র, আমি তারে অনেক দিন থেকে চিনি। কলেজ বন্ধ এই গ্রামে বেড়াতে আসছে। আমি মজিদ স্যারের ক্লাসটা নিতে বলেছি, সে রাজি হয়েছে। তোমরা খবরদার মাসুদ স্যারকে জ্বালাবে না, মাসুদ স্যারের কথা শুনবে।
টিবি স্যার আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন, তারপর মাসুদ স্যার নামে শার্ট প্যান্ট পরা চোখে চশমা কমবয়সী মানুষটাকে ক্লাসে রেখে চলে গেলেন।
কমবয়সী মানুষটা আমাদের দিকে তাকাল, মনে হলো একটু লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে। একটু হেঁটে দুই পা এগিয়ে এসে বলল, শোনো, আমি কিন্তু তোমাদের স্যার না। আমিও তোমাদের মতো একজন ছাত্র। কলেজের ছাত্র। তাই কেউ আমাকে মাসুদ স্যার ডাকবে না।
মামুন জিজ্ঞেস করল, তাহলে কী ডাকব?
ভাই। মাসুদ ভাই।
ঠিক কী কারণ জানা নেই। কথাটা শুনে আমাদের সবার কেমন জানি এক ধরনের আনন্দ হলো। স্কুল মানেই অত্যাচার, স্যার মানেই যন্ত্রণা–তখন যদি স্কুলের কমবয়সী একটা স্যার বলে আমাকে মাসুদ ভাই বলে ডাকবে তাহলে আনন্দ হতেই পারে। আমরা আনন্দে হি হি করে হাসলাম, আমাদের ক্লাসে যে অল্প কয়টা মেয়ে আছে, তারাও একজন আরেকজনের কানে কিছু একটা বলে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে কুট কুট করে হাসল।
চশমা পরা কমবয়সী মানুষটা–যে আমাদেরকে মাসুদ ভাই বলে ডাকতে বলেছে একটু গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, আমি আসলে কখনো কাউকে পড়াই নাই। কেমন করে পড়াতে হয়, জানি না–তার পরও যখন আমাকে পড়াতে বলেছে, তখন কেন রাজি হয়েছি জানো?
আমরা মাথা নেড়ে বললাম যে জানি না। তখন মাসুদ ভাই নামের মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, তার কারণ আসলে কেউ কোনো দিন কাউকে কিছু শিখাতে পারে না। যার যেটা দরকার, সে নিজেই সেটা শিখে নেয়। মাস্টারদের কাজ হচ্ছে উৎসাহ দেওয়া। আমি এসেছি। তোমাদের উৎসাহ দিতে।
শুনে আমাদের খুবই উৎসাহ হলো। শুধু যে মাসুদ ভাই ডাকব তা নয় মাসুদ ভাই কিছু পড়াবেও না, কোনো লেখাপড়া নাই, কী মজার কথা। কী আনন্দের কথা!