আমাকে দেখেই নানি চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে বলতে শুরু করল, এই যে! এই যে লাট সাহেবের বাচ্চা এখন বাড়ি এসেছেন। কখন স্কুল ছুটি হয়েছে আর লাট সাহেবের বাচ্চার এখন সময় হলো বাড়িতে আসার!
কথাটা সত্যি। স্কুল ছুটির পর কোনো দিনই আমি সাথে সাথে বাড়ি আসি না। এসে কী হবে? একটু ঘুরেফিরে বাড়ি আসি। আজকে অবশ্যি সে রকম দেরি হয়নি কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। নানি ধরে নিল দেরি হয়েছে আর হাত-পা নেড়ে বলতে থাকল, যদি পেটে কিছু দিতে না হইত তাহলে লাট সাহেবের বাচ্চা মনে হয় বাড়িতেই আসত না। বান্দরের মতো গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াইত।
নানিকে খেপানোর জন্য বললাম, বান্দরই ভালো। বান্দরদের স্কুল নাই, লেখাপড়া নাই।
নানি ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর বান্দর।
আমি হি হি করে হেসে বললাম, আমি যদি বান্দর হই তাহলে তুমি হলে বান্দরের নানি বান্দরানী।
নানি তখন রেগেমেগে আমাকে ধরার চেষ্টা করল, পারল না। আমি নিজে থেকে ধরা না দিলে নানি কি কোনো দিন আমাকে ধরতে পারবে? মাঝে মাঝে আমি ইচ্ছা করে ধরা দিই, নানি তখন আমার কান মলে দেয়, চুল ধরে টান দেয়–ভান করে খুব রেগেমেগে আমাকে শাস্তি দিচ্ছে, আসলে ওসব কিছু না। আসলে আমাকে একটু আদর করে দেয়। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আধো আধো ঘুমের মাঝে আমি দেখি নানি আমার পাশে বসে আমার মাথায়, চোখে–মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। নানি ছাড়া আমার আর কেউ নাই, নানি আমাকে দেখেশুনে না রাখলে আমি কোথায় যে ভেসে যেতাম। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি না থাকলে নানিও নিশ্চয়ই এত দিনে মরে-টরে যেত।
নানি একেবারে হাল ছেড়ে দেবার ভান করে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, যা হাত-মুখ ধুয়ে একটু মানুষ হয়ে খেতে আয়।
খাওয়ার জন্য কেন হাত-মুখ ধুয়ে মানুষ হতে হবে, সেটা নিয়ে আমি আর নানির সাথে তর্ক করলাম না, কলসি থেকে টিনের মগে একটু পানি ঢেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত-মুখ ধোয়ার একটু ভান করলাম। নানি একটা সিঁড়ি দিল বসার জন্য তারপর থালায় ভাত বেড়ে দিল।
আমি যখন খেতে বসি নানি তখন পাশে বসে থাকে। তার নকশি করা পিতলের পানের বাটা থেকে পান বের করে, কুচি কুচি করে সুপারি কাটে, তারপর পানে চুন-সুপারি দেয়, জর্দা দেয় তারপর পানটা মুখে পুরে খুবই তৃপ্তি করে চিবুতে থাকে। তখন নানিকে দেখে মনে হয় তার থেকে সুখী মানুষ বুঝি পৃথিবীতে আর একজনও নাই।
নানির কথায়বার্তায় অবশ্যি সুখের কোনো নমুনা থাকে না। ফেস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথা বলতে শুরু করে। একা একা কথা বললে মানুষ পাগল বলে তাই নানির কথা বলার জন্য একজন মানুষ দরকার। আশপাশে কেউ থাকলেই নানি কথা বলতে শুরু করে, সেই মানুষটা তার কথা শুনছে কি না, নানির সেটা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা থাকে না। আজকেও নানি কথা বলতে শুরু করল, সেই একই কথা, যেটা আমি একশ বার শুনেছি।
রঞ্জু। ও রঞ্জু তুই ঠিক করে ক। এই কাজটা কি তোর বাপ-মা ঠিক করল? আমি বুড়া মানুষ, আমার ঘাড়ে তোর দায়িত্ব দিয়া তোর বাপ-মা দুইজন চইলা গেল? কাজটা কি ঠিক হইল?
আমি কোনো কথা না বলে খেতে থাকি। নানি আসলে আমার মুখ থেকে কোনো উত্তর শুনতে চায় না, এমনিই বলে।
আমি তোর বাপরে বললাম, দিনটা ভালো ঠেকে না। মনের মাঝে কু-ডাক দেয়। বাবা আজকে না গেলে হয় না? তোর বাপ হাসে। বলে আম্মাজান কুনো ভয় নাই। আপনার মেয়ের দায়িত্ব আমার। বুকে থাবা দেয় আর কয়, শরীলে যতক্ষণ দম আছে আপনার মেয়ের কিছু হতে দিমু না। তা কথা মিছা কয় নাই।
নানি তার আঙুলের ডগায় লাগানো চুন জিবের ডগায় লাগিয়ে বিড়বিড় করে বলল, শরীলে যতক্ষণ দম ছিল তোর মায়ের কিছু হইতে দেয় নাই। যখন দম শেষ তোর বাপ শেষ, তোর মাও শেষ। রাক্ষুসী কালী গাং তোর মুখে আগুন তোর চৌদ্দ গুষ্টির মুখে আগুন তুই জাহান্নামে যা, হাবিয়া দোজখে তুই জ্বলেপুড়ে মর। মুখে রক্ত উঠে তুই মর, তুই নির্বংশ হ, তোর বংশে বাতি দেওয়ার জন্য যেন কেউ না থাকে–
নানি এমন ভাবে কালী গাংকে অভিশাপ দিতে থাকে, যেন সেটা একজন মানুষ। নানির কাছে শুনেছি আমার বাবা-মা কালী গাংয়ে ডুবে মারা গেছে, নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা ঝড় উঠেছে, কিছু বোঝার আগে নৌকাটা পাক খেয়ে ডুবে গেছে। আমি ছোট, নানির কাছে ছিলাম বলে বেঁচে গেছি। বাবা খুব ভালো সাঁতার জানত, মাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে বাঁচতে পারে নাই। আমার কিছু মনে নাই, বাবা-মায়ের চেহারাও কোনো দিন দেখি নাই। বাড়িতে তাদের একটা ফটোও নাই।
নানি পান চিবুতে চিবুতে একটু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে, রঞ্জু, ভাইডি তুই খুব সাবধানে থাকবি। বাপ-মা থাকলে তার দোয়া থাকে। তোর বাপও নাই, মাও নাই। তোর জন্য দোয়া করার কেউ নাই–
আমি বললাম, তুমি দোয়া করবা।
নানির দোয়া কামে লাগে না। বাপ-মা অন্য রকম–
তোমার দোয়া কামে না লাগলে আমার দোয়ার দরকার নাই। দোয়া ছাড়াই আমি থাকতে পারি নানি–
খুবই একটা ভয়ংকর কথা বলে ফেলেছি এ রকম ভান করে নানি বলল, ছি ছি ছি, এই রকম বলে না। দোয়া লাগে। সবার দোয়া লাগে।
নানি বিড়বিড় করে নিজের মনে কিছুক্ষণ কথা বলে তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা কথা সব সময় মনে রাখবি রঞ্জু।