আমি ঢাকা শহরের কিছু চিনি না, কিন্তু মানুষগুলোর মুখে মুখে যুদ্ধের বর্ণনা শুনে আমার মনে হতে লাগল আমি বুঝি ঢাকা শহরটাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
খেয়ে-দেয়ে মানুষগুলো যে যেখানে জায়গা পেয়েছে, সেখানেই শুয়ে পড়ল, দেখতে দেখতে তারা ঘুমিয়ে পড়ল। আমি তাদের মাঝে ঘুরে ঘুরে মানুষগুলোকে দেখতে লাগলাম। কয়েক দিন আগেও তাদের ঘরবাড়ি সবকিছু ছিল, এখন তারা পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে কোনখানে যাবে কিছু জানে না। কে কী খাবে কোথায় ঘুমাবে, সেটাও জানে না, কী আশ্চর্য!
হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের শেষ মাথায় এসে আমি থমকে দাঁড়ালাম। বারান্দায় একজন মহিলা সোজা হয়ে বসে আছে, তার পাশে আরেকজন একটা প্লেটে একটু ভাত আর ডাল নিয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। মহিলাটি খাচ্ছেন না কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন, তার চোখের দৃষ্টি দেখলে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এ রকম শূন্য দৃষ্টি আমি কখনো দেখিনি। শুধুমাত্র মানুষ মরে গেলেই বুঝি এ রকম দৃষ্টি হওয়া সম্ভব।
পাশে দাঁড়ানো মানুষটি বলল, আপা, একটু খাও। একটু–
মহিলাটি কোনো কথা না বলে সেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি আগে কখনো এ রকম দীর্ঘশ্বাস শুনিনি, মনে হয় বুকের ভেতর থেকে একটা হাহাকার বের হয়ে এল।
কী হয়েছে জানার জন্য আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম ঠিক তখন আমার পিঠে কে যেন হাত রাখল, তাকিয়ে দেখি মাসুদ ভাই। মাসুদ ভাই পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে আমাকে সরিয়ে নিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই বলল, ওনাকে একটু একা থাকতে দাও।
কেন মাসুদ ভাই? ওনার কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, ঢাকা শহরে কারফিউ তোলার পর তারা সেখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। সারা দিন হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যেবেলা এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছেন তখন আবার হঠাৎ সেখানে মিলিটারি হামলা করল। সবাই তখন পাগলের মতো ছুটতে আরম্ভ করেছেন।
মাসুদ ভাই একটু থামল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, তখন কী হয়েছে?
ছোট মেয়েটার হাত ধরে ছুটছেন, তখন হাত থেকে মেয়েটা ছুটে গেল। আবার ধরে ফেলল, তারপর ছুটতে লাগলেন–অনেক দূর ছুটে গিয়ে দেখেন–
কী দেখেন?
মাসুদ ভাই আবার নিঃশ্বাস ফেলল, দেখেন অন্য একটা ছোট বাচ্চার হাত ধরে ছুটছেন! সেই বাচ্চাটা বেঁচে গেছে নিজের মেয়ে হারিয়ে গেছে–আর খুঁজে পাননি।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাসুদ ভাই বলল, বুঝলে রঞ্জু, এটা হচ্ছে যুদ্ধ। পৃথিবীতে যুদ্ধ থেকে ভয়ংকর আর কিছু নেই। কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না।
.
০৭.
পরের এক সপ্তাহ শুধু মানুষ আসতে লাগল, একটু বিশ্রাম নিয়ে, কিংবা এক রাত থেকে তারা আবার চলে যেতে লাগল। কাঁকনডুবি গ্রামের সব মানুষ মিলে এই মানুষগুলোর থাকা-খাওয়া আর বিশ্রাম নেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। এই কাজগুলো মাসুদ ভাই খুব ভালো পারে, তার সাথে কাঁকনডুবি গ্রামের অনেক কমবয়সী মানুষ আছে, আমরাও আছি। প্রথম প্রথম সবাই আমাদের তাড়িয়ে দিত, বলত, যাও যাও! ছোট পোলাপান ঝামেলা করো না। আমরা তবু আশপাশে থাকতাম, কাজে সাহায্য করতাম, পানি এনে দিতাম, কলাপাতা ছিঁড়ে দিতাম, খাওয়ার পর কলাপাতা টুকিয়ে ফেলে আসতাম। কুকুরগুলোকে তাড়াতাম–আস্তে আস্তে বড়রা আমাদের মেনে নিল, নিজে থেকে আমাদের ছোটখাটো ফাই-ফরমাশ দিতে লাগল। আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে সেগুলো করতে লাগলাম।
মানুষজন যখন চলে যেত তখন আমরা তাদের বড় সড়কে তুলে, কোন দিক দিয়ে যেতে হবে সেটা দেখিয়ে দিতাম। তাদের কারো কাছে জিনিসপত্র বেশি কিছু থাকত না–যেটুকু থাকত সেটাই আমরা ঘাড়ে করে খানিক দূর নিয়ে দিতাম।
একজন মাঝবয়সী মানুষ তার বউ আর মোল-সতেরো বছরের মেয়েকে আমরা বড় সড়কে তুলে দিয়ে যখন চলে যাচ্ছি তখন মানুষটি দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, খোকা, তোমার নাম কী?
আমি বললাম, রঞ্জু। ভালো নাম–
মানুষটি বলল, ভালো নাম লাগবে না। রঞ্জু দিয়েই হবে। বুঝেছ রঞ্জু, একদিন এই যুদ্ধ শেষ হবে। হবে না?
আমি বললাম, হবে। জয় বাংলা হবে।
হ্যাঁ। জয় বাংলা হবে। তখন তুমি আমার বাসায় আসবে। আমার অনেক বড় বাসা, বাসার সামনে মাঠ। সেখানে শীতকালে আমরা কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলব। ঠিক আছে?
আমি বললাম, ঠিক আছে।
মানুষটা বলল, আমার বাসায় একটা লাইব্রেরি আছে সেখানে অনেক বই। তুমি বই পড় তো?
আমি বই পড়ি না কিন্তু সেটা তো বলা যায় না, তাই বললাম, হ্যাঁ। পড়ি।
গুড, তাহলে আমরা লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ব। তখন আমার রেকর্ড প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা এলপি লাগিয়ে দেব। প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়–তুমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনো তো?
আলাউদ্দিন চাচা ছাড়া আর কারও গান আমি শুনি নাই কিন্তু আমি মাথা নেড়ে বললাম যে শুনি। মানুষটা তখন বলল, তখন আমরা সবাই বসে গান শুনতে শুনতে গল্পের বই পড়ব। ঠিক আছে?
আমি বললাম, ঠিক আছে।
তারপর মানুষটা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তার স্ত্রী আর খোল সতেরো বছরের মেয়েটাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গেল। যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে জয় বাংলা হবে তখন এই মানুষটাকে আমি কোথায় খুঁজে পাব, মানুষটা বলে গেল না। আমিও মানুষটাকে জিজ্ঞেস করলাম না। কিন্তু মানুষের কথাগুলো আমার মাথার মাঝে ঘুরঘুর করতে লাগল, আমি কল্পনা করতে লাগলাম একটা সুন্দর বাসার ভেতরে একটা বড় ঘর, দেয়ালে সারি সারি বই সেখানে হেলান দিয়ে বই পড়ছি, বই পড়তে পড়তে গান শুনছি। যতবার চিন্তা করি ততবার কেমন যেন ভেতরে একটা শান্তি শান্তি লাগে। কী আশ্চর্য।