একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি যাবেন কোনখানে।
কৈলাসপুর। আমার বাড়ি কৈলাসপুর।
সেটা তো মেলা দূরে। আপনি বিশ্রাম নেন। খান, তারপর কাল সকালে যাবেন।
মানুষটা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, না না, আমার এখনই যেতে হবে। এখনই বাড়ি যেতে হবে। কথা শেষ না করে আবার কাঁদতে লাগল।
সবাই মিলে মানুষটাকে জোর করে খাইয়ে দিল। খাওয়ার পর পরই মানুষটা সড়ক ধরে হাঁটতে লাগল। একজন বলল, মাথাটা আউলে গেছে। পুরাপুরি আউলে গেছে।
আমি মাথা আউলে যাওয়া মানুষটার পিছু পিছু অনেক দূর হেঁটে গেলাম, গ্রাম শেষ হবার পর যখন ধানক্ষেত শুরু হয়ে গেছে তখন আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখলাম মানুষটা ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বাড়িতে তার কে আছে কে জানে। বাড়িতে গিয়ে সে কাকে কী বলবে, সেইটাই বা কে জানে।
পরের দিন ভোরবেলা ঢাকা থেকে আরো দুইজন লোক এল। ঘণ্টা খানেক পর আরো কয়েকজন। তারপর একসাথে প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ হাজির হলো। সেখানে ছেলে-বুড়ো আর মহিলাও আছে। হঠাৎ করে ভটভট শব্দ করে একটা লঞ্চ এসে কালী গাংয়ের ঘাটে থামল, সেখান থেকে অনেক মানুষ নামল। তারপর হঠাৎ করে সড়ক ধরে শত শত মানুষ আসতে লাগল, আমি জীবনেও একসাথে এত মানুষ দেখি নাই।
মানুষগুলো একেবারে বিধ্বস্ত, তাদের হেঁটে অভ্যাস নাই তাই পাগুলো একেবারে কেটে কুটে ফুলে আছে। চোখের নিচে কালি, ঠোঁটগুলো শুকনো, মহিলারা ছোট ছোট বাচ্চাদের বুকে চেপে রেখেছে। বাচ্চাগুলো চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এখন আর কাঁদতেই পারছে না। অনেক মানুষের জামাকাপড় রক্তমাখা কেউ কেউ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, কেউ কেউ অন্যের ঘাড় ধরে হাঁটছে। মানুষগুলো গত এক-দুই দিন মনে হয় কিছু খায়নি, চেহারা দেখলেই সেটা বোঝা যায়। সবগুলো মানুষের চেহারার মাঝে একটা মিল আছে, সেটা হচ্ছে ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। ভয়ের চিহ্নটি এতই স্পষ্ট যে দেখলেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। সব সময়েই এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। তাদের দেখে মনে হয় হঠাৎ করে কেউ বুঝি তাদের ওপর লাফ দিয়ে পড়বে।
গ্রামের মানুষজন নিজেদের সাথে কথা বলে এই মানুষগুলোর থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করল আমাদের গ্রামের মানুষগুলো মোটামুটি সহজ-সরল। একটু লোভী, একটু কিপটে, একটু স্বার্থপর কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম এই শত শত মানুষকে দেখে হঠাৎ তাদের ভেতরকার সব খারাপ বিষয়গুলো যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই মিলে এই মানুষগুলোকে সাহায্য করতে শুরু করল। মাসুদ ভাই মনে হলো একটা মনের মতো কাজ পেল, সবার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে শুরু করে দিল। যাদের সাথে ছোট বাচ্চাকাচ্চা আছে তাদেরকে গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে লাগল। আমিও দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা আর তাদের কমবয়সী বাবা-মাকে বাড়িতে নিয়ে এলাম। একটু ভয়ে ভয়ে ছিলাম নানি দেখে না আবার রেগে ওঠে কিন্ত নানি একটুও রাগল না। বউটার হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে জলচৌকিতে বসিয়ে বলল, মা, তুমি যত দিন খুশি আমার বাড়িতে থাকে। তোমার কোনো চিন্তা নাই।
নানির কথা শুনে বউটা কেঁদে ফেলল, আর মাকে কাঁদতে দেখে ছোট ছোট দুইটা বাচ্চা অবাক হয়ে তাদের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবাটা কেমন যেন বেখাপ্পাভাবে উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে এদিক-সেদিক তাকাতে লাগল। ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। চেহারা দেখে বোঝা যায় এরা শহরের বড়লোক মানুষ এখন এই গাঁওগেরামে এসে অন্যের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। আমি নানিকে বললাম, নানি আমি যাই।
অন্য দিন হলে নানি জিজ্ঞেস করত, কই যাস? কখন আসবি? আজকে কিছুই জিজ্ঞেস করল না, বলল, যা।
আমি বললাম, নানি, অনেক মানুষ আছে স্কুলে তাদের জন্য সবাই ভাত রেন্ধে দিচ্ছে। তুমিও রেন্ধে দিয়ো।
নানি বলল, ঠিক আছে। তারপর বলল, তুই যাবার আগে মাচার ওপর থেকে বড় ডেগ দুইটা নামায়া দে।
আমি মাচার ওপর থেকে বড় দুইটা ডেকচি নামিয়ে দিলাম, অনেক মানুষের জন্য রাঁধতে হলে বড় ডেকচি লাগতেই পারে।
.
স্কুলে সব মানুষের জন্য খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। অল্প কিছু থালা-বাসন আছে বাকি সবাই কলাপাতায়। মানুষগুলো হাভাতের মতো খায়, দেখে মনে হয় এরা বুঝি জন্মেও খেতে পায়নি। চেহারা দেখে বোঝা যায় এদের মাঝে অনেকেই বড়লোক, বাসায় নিশ্চয়ই পোলাও কোরমা খায়। এখানে তারা শুধু ডাল আর ভাত এত তৃপ্তি করে খাচ্ছে যে দেখে আমারই খেতে লোভ হচ্ছে।
মানুষগুলো খাওয়ার পর একটু একটু করে মুখ খুলতে শুরু করে, সেগুলো শুনে আমাদের মন খারাপ হয়ে যেতে লাগল। তারা বলল, রাজারবাগে পুলিশের সাথে আর পিলখানায় ইপিআরের সাথে যুদ্ধ হয়েছে। পিলখানায় ইপিআরের কাছে অস্ত্র ছিল না, পাকিস্তান মিলিটারি আগেই তাদের নিরস্ত্র করে রেখেছে, তাই যুদ্ধ হয়েছে একতরফা। রাজারবাগে পুলিশের কাছে অস্ত্র ছিল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, সেইটা দিয়েই ভয়ংকর যুদ্ধ করে মিলিটারিদের ঠেকিয়ে দিয়েছে। মিলিটারি তখন ভারী অস্ত্র এনে রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলগুলোকে মিলিটারি আক্রমণ করেছে। যত ছাত্র ছিল সবাইকে মেরে ফেলেছে। সবচেয়ে বেশি মেরেছে ইকবাল হল আর জগন্নাথ হলে। শাঁখারীপট্টি পুরোটা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বস্তিগুলোও জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন থেকে বাঁচার জন্য যখন মানুষগুলো বের হয়েছে, তখন সবাইকে পাখির মতো গুলি করে মেরেছে।