আকাশবাণী কলকাতা থেকে শুধু আমার সোনার বাংলা গানটি গেয়ে শোনাচ্ছে, একবার বলে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, পাকিস্তান মিলিটারির সাথে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ছাত্র-জনতা যুদ্ধ করছে, তারপর আমার সোনার বাংলা গানটি শোনায়! আর অন্য কোনো অনুষ্ঠান নাই।
বিবিসি শুনে বোঝা গেল ঢাকায় সবচেয়ে ভয়ংকর অবস্থা। পুরো শহরটা মনে হয় ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে, কত লোক মারা গেছে তার কোনো হিসাব নাই। বাইরে থেকে কেউ কোনো খবর পাচ্ছে না, কারণ সব বিদেশি সাংবাদিকদের ধরে জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা এয়ারপোর্টে যাবার সময় যেটুকু দেখেছে তাতেই পুরোপুরি স্তম্ভিত। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
আমি বেশ কিছুক্ষণ বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বসে থাকলাম, রেডিওতে যা বলছে, লোকজন যেসব আলোচনা করছে সেগুলো শুনলাম। মাসুদ ভাই এক কোনায় বসে উত্তেজিতভাবে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। যখন বিদেশি কোনো রেডিও স্টেশনে ইংরেজিতে কিছু বলে মাসুদ ভাই সেটা বাংলায় বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সবাই মাসুদ ভাইয়ের কাছে জানতে চাইছিল এখন কী হবে, মাসুদ ভাই এই প্রশ্নটার উত্তর ভালো করে দিতে পারে না। মাথা চুলকে বলে, যদি পাকিস্তান মিলিটারিকে এখন হারিয়ে দিতে পারি তাহলে তো হয়েই গেল–
যদি না পারি?
তাহলে যুদ্ধ হবে। গেরিলা যুদ্ধ।
কত দিন?
মাসুদ ভাইয়ের মুখটা শক্ত হয়ে যায়, চাপা স্বরে বলেন নয়-দশ বছর।
সেটা শুনে সবাই অবিশ্বাসের শব্দ করে। একজন জিজ্ঞেস করে, এত দিন?
মাসুদ ভাই বলেন, আপনি জানেন ভিয়েতনাম কত দিন থেকে আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করছে?
কেউই সেটা জানে না, তার পরেও সবাই এমনভাবে মাথা নাড়ল যেন সবকিছু জানে! আমাদের গ্রামের মানুষগুলো এ রকমই।
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমি বের হলাম, বাড়ির কাছাকাছি আসার পর রাস্তায় মামুনের সাথে দেখা হলো। গাধাটা সারা রাত ঘুমিয়েছে, দেশে কী হচ্ছে কিছুই জানে না। সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে সেটা শুনে এত অবাক হলো যে বলার মতো নয়। আমি যখন তাকে সবকিছু বলছি তখন সেটা শোনার জন্য আমার চারপাশে আরো কিছু মানুষ জড়ো হয়ে গেল। আমি একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম। একজন জিজ্ঞেস করল, বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন?
আমি পরিষ্কার জানি না তার পরেও বলে দিলাম, নিরাপদে আছেন, গোপন জায়গা থেকে যুদ্ধের অর্ডার দিচ্ছেন।
যুদ্ধের কী অবস্থা?
ভাসা ভাসা যেটুকু শুনেছি সেটাই একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম, চিটাগাং আমাদের দখলে। সেইখান থেকে আমাদের সৈন্য ঢাকার দিকে আগাচ্ছে। কালকের ভেতর ঢাকা দখল করে ফেলবে।
ঢাকার অবস্থা কী?
খুব খারাপ, ঢাকা শহরের একটা মানুষও বেঁচে নাই।
ইয়া মাবুদ।
আমি আর মামুন গ্রামের মাঝে ঘুরে বেড়ালাম। অনেকেই আমাদের কাছে দেশের খবর জানতে চাইল, আমি আমার মতো করে দেশের খবর দিতে লাগলাম, আমার দেখাদেখি একটু পরে মামুনও বানিয়ে বানিয়ে যুদ্ধের খবর বলতে লাগল। মোটামুটিভাবে বিকেলের মাঝে কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই জেনে গেল, ঢাকা শহরে একজন মানুষও বেঁচে নাই কিন্তু এ ছাড়া পুরো বাংলাদেশ আমাদের দখলে। তুমুল যুদ্ধ করে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হারিয়ে সবাই ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। ঢাকা যেকোনো সময়ে দখল হয়ে যাবে। তখন সারা দেশ হবে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু হবেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট।
.
পরের দিন দুইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল, দুপুরের দিকে চিটাগাং রেডিও স্টেশন থেকে মেজর জিয়া নামে একজন বঙ্গবন্ধুর নামে একটা ঘোষণা দিয়ে বলল বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। শুনে আমরা আনন্দে লাফাতে লাগলাম, আমি আর মামুন সবচেয়ে বেশি খুশি হলাম, তার কারণ আমরা নিজে থেকেই এটা আগেই সবাইকে বলে রেখেছি, আমাদের কথাটাই সত্যি বের হয়েছে।
বিকেলের দিকে অবশি একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। ঢাকা থেকে সরাসরি একজন মানুষ আমাদের কাঁকনডুবিতে হাজির হলো। মানুষটার খালি পা, পরনে লুঙি, গায়ে একটা ছেড়া শার্ট সেই শার্টে শুকনো রক্তের দাগ। মানুষটার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটো টকটকে লাল। চেহারার মাঝে এক ধরনের ভয়ের ছাপ।
সবাই মানুষটাকে ঘিরে দাঁড়াল, একজন জিজ্ঞেস করল, ভাই ঢাকার কী অবস্থা?
খুবই সহজ একটা প্রশ্ন, উত্তর দেওয়া মোটেই কঠিন না কিন্তু মানুষটা উত্তর না দিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। যখন একজন বড় মানুষ কাঁদে সেই দৃশ্যটা কেন জানি খুবই খারাপ লাগে। আমার দেখার ইচ্ছা করছিল না, তবু দাঁড়িয়ে রইলাম।
আমাদের কাঁকনডুবির একজন মুরব্বি মানুষটার গায়ে হাত দিয়ে বলল, বাবা, কান্দো কেন? বলো কী হইছে?
মানুষটা শার্টের হাতায় চোখের পানি নাকের পানি মুছে বলল, আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না কী অবস্থা! আমাদের বাসায় একটা জয় বাংলার পতাকা টানানো ছিল, নামাতে মনে নাই, মিলিটারি এসে বাসায় আগুন দিল। আমরা আগুন থেকে বাঁচার জন্য বাসা থেকে বের হইছি তখন সাথে সাথে গুলি। গুলি আর গুলি–
মানুষটা আবার কাঁদতে লাগল। সবাই তাকে ঘিরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, কী করবে বুঝতে পারছিল না। একসময় মানুষটা কান্না একটু থামিয়ে বলল, আমি ভাবছিলাম আমার গুলি লাগছে, আমি বুঝি মরেই গেছি। যখন জ্ঞান হইছে দেখি আমি মরি নাই। আমার উপরে লাশ নিচে লাশ পাশে লাশ। কোনোভাবে লাশের ভেতর থেকে বের হইয়া দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। রাত নাই দিন নাই খালি হাঁটতে হাঁটতে দৌড়াইতে দৌড়াইতে এইখানে আসছি।