আমাদের কাঁকনডুবিতেও একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব শুরু হয়েছে। পাশের গ্রাম থেকে ইপিআরের সুবেদারকে খুঁজে বের করে মাসুদ ভাই মিলিটারি ট্রেনিং শুরু করেছে। স্কুলের মাঠে বিকেলবেলা ছেলেদের নিয়ে সুবেদার লেফট-রাইট করায়। সুবেদারের কেমন জানি রাগী রাগী চেহারা দেখলে ভয় লাগে। মাসুদ ভাই থানার সাথে যোগাযোগ করেছে তাদের রাইফেলগুলো ধার দেওয়ার জন্য। তাহলে সবাইকে রাইফেল চালানো। শেখাবে। আমরা বিকেলবেলা স্কুলের মাঠে বসে বসে ট্রেনিং দেখি। খুবই সোজা ট্রেনিং। ইচ্ছা করলেই আমরা এই ট্রেনিং নিতে পারি কিন্তু ছোট বলে আমাদের নেয় না। দুঃখে আমার হাত কামড়াতে ইচ্ছা করে।
মাসুদ ভাই বাংলাদেশের একটা পতাকাও তৈরি করে এনেছে। সবুজের মাঝখানে লাল একটা সূর্য, তার ভেতরে হলুদ রঙের পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ–এখন অবশ্যি আমরা কেউ পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাপ বলি না, বলি বাংলাদেশের ম্যাপ। বাংলাদেশের ম্যাপটা হওয়ার কথা সোনালি রঙের, সোনালি রং পাওয়া ঝামেলা বলে কাছাকাছি হলুদ রং তৈরি করা হয়েছে। বড় পতাকাটা স্কুলের মাঠে টানানো হয়, সবাই যখন লেফট-রাইট করে তখন এই পতাকাটাকে স্যালুট করতে হয়। মাসুদ ভাই বলেছে আরো ছোট ছোট বাংলাদেশের ফ্ল্যাগ তৈরি করে দেবে, আমরা সেগুলো আমাদের বাড়িতে টানাব। সারা দেশে কারফিউ দিয়ে মানুষজনকে মারছে সেই জন্য বাংলাদেশের পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও টানাতে হবে। কালো পতাকা বানানো অবশ্যি সোজা, একটা কালো কাপড়কে চারকোনা করে কাটলেই হয়ে গেল, সেই তুলনায় বাংলাদেশের পতাকা অনেক কঠিন। ম্যাপটা বানাতেই বারোটা বেজে যায়। সেটা সেলাই করে লাগানো আরো কষ্ট।
সবকিছু মিলিয়ে চারপাশে অস্থির অস্থির ভাব, কবে যে এই অস্থির ভাবটা শেষ হবে কে জানে।
.
মার্চ মাসের ২৫ তারিখ একটা ভাসা ভাসা গুজব শোনা গেল যে ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর আলাপ নাকি ভেঙে গেছে। ব্যাপারটা ভালো হলো না খারাপ হলো আমি বুঝতে পারলাম না। বিকেলবেলা স্কুলে যখন মিলিটারি ট্রেনিং হচ্ছে তখন মাসুদ ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাইও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না। ছাত্ররা নাকি সারা ঢাকা শহরে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে যেন মিলিটারি কোথাও যেতে না পারে।
.
রাত্রিবেলা যখন শুয়েছি তখন শুনলাম একটা কুকুর ঠিক মানুষের কান্নার মতো শব্দ করে ডাকছে, শুনে কেমন জানি ভয় করে। নানি বলল, এই অপয়া কুত্তাটা এই রকম করে কান্দে কেন? এই কু-ডাক তো ভালো না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয় এইভাবে ডাকলে?
বিপদের সময় কুত্তারা এইভাবে কান্দে।
কুকুর বিপদের খবর আগে থেকে পায় তার কারণটা কী হতে পারে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।
গভীর রাত্রে নানি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল, বলল, এই রঞ্জু ওঠ। তাড়াতাড়ি।
আমি ধড়মড় করে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে নানি?
কী যেন হয়েছে। শুনতে পাচ্ছিস না?
আমি কান পেতে শুনলাম, আমাদের বাড়ির সামনে সড়কে মানুষের গলার শব্দ। তার মাঝে একজন কোনো একটা কিছুতে ঠনঠন করে শব্দ করল, তখন মানুষের গলায় শব্দ থেমে গেল, তখন একজন চিৎকার করে কিছু একটা বলতে লাগল। ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না তাই আমি দরজা খুলে ছুটে বাইরে বের হয়ে এলাম, নানি আমাকে থামাল না। নিজেও পেছনে পেছনে বের হয়ে এল।
বাড়ির সড়কে এই মাঝরাত্রেও অনেক ভিড়। একজনের হাতে হ্যারিকেন, সামনে একজনের হাতে একটু কেরোসিনের খালি টিন, মানুষটা এটাতে বাড়ি দিয়ে ঠনঠন শব্দ করে। সবার সামনে আমাদের গ্রামের নজু ভাই। মাসুদ ভাইয়ের মিলিটারি ট্রেনিংয়ে সব সময় থাকে। নজু ভাই চিৎকার করে বলছে, জাগো। গ্রামবাসী জাগো। জাগো দেশবাসী জাগো। জাগো বাঙালি জাগো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তান মিলিটারি ঢাকা শহরে আক্রমণ করেছে। পুলিশ ইপিআর ছাত্র-জনতা তাদের সাথে যুদ্ধ করছে। ঢাকা শহরে এখন ভয়ংকর যুদ্ধ হচ্ছে। এই যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ।
আমার বুকের ভেতরটা জানি কেমন করে উঠল। মানুষগুলো হেঁটে হেঁটে চলে যাবার পরও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম দূর থেকে নজু ভাই চিৎকার করে ডাকছে, জাগো দেশবাসী জাগো। জাগো দেশবাসী জাগো!
নানি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, আয়, ঘরে আয়।
আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, নানি। এখন কী হবে?
নানি উত্তর দেবার আগেই কুকুরটা ঠিক মানুষের কান্নার মতো শব্দ করে ডেকে উঠল। কী ভয়ংকর সেই ডাক।
নানি চাপা গলায় বলল, ফি আমানিল্লাহ! ফি আমানিল্লাহ!
২. বলাই কাকুর চায়ের স্টল
দ্বিতীয় পর্ব
০৬.
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে খুব ভিড়। মানুষগুলোর উশকু-খুশকো চেহারা, কাল রাতে মিলিটারি ঢাকা শহর আক্রমণ করেছে খবর পাবার পর কেউ আর ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি। ঢাকা রেডিও স্টেশনে খুবই খারাপ উচ্চারণে একজন মাঝে মাঝে হুমকি-ধামকি দিয়ে কথা বলছে–কী অবাক লাগে যখন একটা রেডিও থেকে কেউ এই ভাষায় কথা বলে। চিটাগাং রেডিও স্টেশনটা ঠিক আছে, সেখানে জানা গেল সারা দেশে প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে, পাকিস্তানি মিলিটারি যুদ্ধে প্রায় হেরেই যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সবার দুশ্চিন্তা, জানা গেল বঙ্গবন্ধু নিরাপদে আছেন। সেটা শুনে বলাই কাকুর চায়ের দোকানে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বঙ্গবন্ধু ভালো থাকলেই কেউ কিছু করতে পারবে না।