ঠিক যখন ভাষণ শুরু হতে যাবে তখন রেডিও থেকে প্রচার বন্ধ করে দিল। যারা হাজির ছিল প্রথমে সবাই রেগে চিৎকার করে উঠল, তখন একজন বলল, রেসকোর্সে কিছু হয় নাই তো? মিলিটারি আক্রমণ করে নাই তো?
তখন সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল। সত্যিই তো রেসকোর্সে মিলিটারি আক্রমণ করে নাই তো? বঙ্গবন্ধুর কিছু হয় নাই তো?
বলাই কাকু তাড়াতাড়ি রেডিওর নব ঘুরিয়ে অন্যান্য স্টেশনে কী বলে শোনার চেষ্টা করলেন, আকাশবাণীতে শুনলেন, সবকিছু শুনে বুঝলাম বঙ্গবন্ধুর কিছু হয় নাই, শুধু পাকিস্তানিরা তার ভাষণটা প্রচার করতে দিচ্ছে না। রাগে আমার গা জ্বলে গেল! এই মুহূর্তে ঢাকার রেসকোর্সে যে বিশ লক্ষ মানুষ আছে শুধু তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা শুনতে পাচ্ছে, আমরা কেউ শুনতে পাচ্ছি না।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি ছটফট করে বেড়ালাম, রাত্রিবেলা খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে নাকি এমন একটা ভাষণ দিয়েছেন যে রকম ভাষণ সারা পৃথিবীতে আগে কেউ কখনো দেয় নাই পরেও কেউ কখনো দেবে না! আজকে থেকে পূর্ব পাকিস্তান হচ্ছে বাংলাদেশ সেই কথাটা বলেন নাই কিন্তু পরিষ্কার বলে দিয়েছেন এই সংগ্রামটা এখন স্বাধীনতা সংগ্রাম! সবাইকে বলেছেন দরকার হলে যার কাছে যেটা আছে, সেটা নিয়েই যুদ্ধ করতে হবে। পাকিস্তানিরা এইটা মানতেও পারছে না, আবার কিছু করতেও পারছে না।
আমি যখন রাত্রে বাড়ি এসেছি তখন নানি পারলে আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলে। চিৎকার করে হাত-পা নেড়ে বলতে লাগল, ওরে আমার লবাবের বাচ্চা, দেখো কত রাতে বাড়িতে আসে–
আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটা শুনতে চাচ্ছিলাম–
তুই ভাষণ শুনবি? আগে আমার ভাষণ শোন! দিন নাই, রাত নাই ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াবি, আমি বুড়া মানুষ আজকে আছি, কালকে নাই–আমার উপরে তোর মায়া-দয়া নাই? তোর বাপ-মা এইটা কেমন করে করল? আমার কাছে তোর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল। আমি তোরে কেমন করে মানুষ করব? তোর নাকে টিপলে দুধ বের হবে আর তুই মাঝরাত্রে বাড়ি ফিরে আসিস, যত দিন যায় তত জংলি হয়ে বড় হচ্ছিস–
আমি বললাম, বেশি রাত হয় নাই নানি। কাজীবাড়ির ঘড়িতে দেখে আসছি মাত্র আটটা–
আমারে তুই ঘড়ির টাইম শুনাবি? আর কী শুনাবি তুই? আয় তুই কাছে, যদি তোর কান আজকে টেনে ছিঁড়ে না ফেলি।
নানির রাগ বেশিক্ষণ থাকে না, তাই আমি মুখের মাঝে একটা কাঁচুমাচু ভাব করে নানির কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে লাগলাম। নানি টানা চিৎকার করতে লাগল, আমি ধৈর্য ধরে শুনতে লাগলাম। নানির চিৎকার শুনতে আমার ভালোই লাগে!
.
এর পরের দিনগুলো কেমন যেন অস্থির অস্থিরভাবে কেটে যেতে লাগল। এমনিতে কাঁকনডুবি গ্রামটা দেখে বোঝারই উপায় নাই সারা দেশে কত কী ঘটে যাচ্ছে। টিক্কা খানকে গভর্নর বানিয়েছে কিন্তু হাইকোর্টের জজ তাকে শপথ পড়াতে রাজি হন নাই, তাই টিক্কা খান নাকি মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে বলেছে বঙ্গবন্ধু যেন এখনই কিছু না করে ফেলেন–সে বঙ্গবন্ধুর সাথে মীমাংসা করার কথা বলতে আসছে। শুধু ইয়াহিয়া খান না পশ্চিম পাকিস্তানে ইলেকশনে জিতেছে যে মানুষ–জুলফিকার আলী ভুট্টো সেও আসছে। আমি অবশ্যি ভেবে পাই না একজন মানুষের নাম ভুট্টো হয় কেমন করে? ভুট্টা কিংবা ভুট্টো যদি নাম হতে পারে তাহলে মাষকলাইয়ের ডাল কেন নাম হতে পারে না? জুলফিকার আলী মাষকলাইয়ের ডাল! কেমন লাগে শুনতে?
একদিন খবর পেলাম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়া খানের সাথে সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টো আর ছোট-বড়-মাঝারি অনেক নেতা চলে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে মনে হয় সবার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। একজনের পর আরেকজন বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করে যাচ্ছে। এত আলাপের কী আছে আমি বুঝি না। ঘাড় ধরে সবগুলোকে আমাদের দেশ থেকে বের করে দিলেই হয়!
একদিন বলাই কাকুর চায়ের স্টলে যখন কেউ নাই, বলাই কাকু তার কাঁচের গ্লাসে বেশি করে দুধ-চিনি দিয়ে আমাকে আধা গ্লাস ফ্রি চা বানিয়ে দিয়েছে তখন আমি চা খেতে খেতে বলাই কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা বলাই কাকু, বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাথে অন্য সবগুলোকে ঘাড় ধরে বের করে দেয় না কেন?
বলাই কাকু হেসে ফেললেন, কেমন করে বের করবেন?
মনে নাই তার ভাষণে বিশ লাখ লোক হয়েছিল! এই বিশ লাখ লোককে অর্ডার দেবেন, বলবেন যাও সবাইকে ঘাড় ধরে বের করে দাও।
বলাই কাকু এবারে হাসলেন না, বললেন, সেই কাজটা বেআইনি হতো। বঙ্গবন্ধু এখন পর্যন্ত একটা বেআইনি কাজ করেন নাই!
তারা বেআইনি কাজ করলে দোষ নাই, প্রত্যেক দিন গোলাগুলি করে, মানুষ মারে তখন কিছু হয় না। আর বঙ্গবন্ধু করলে দোষ?
বলাই কাকু মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেক দিনই কিছু না কিছু হচ্ছে। জয়দেবপুরে তো বাঙালিদের সাথে পাকিস্তানিদের একটা যুদ্ধই হয়ে গেল।
কোথায় কোথায় কীভাবে যুদ্ধ হয়েছে আমি জানতাম না, বলাই কাকু সেগুলোর গল্প শোনালেন। সোয়াত নামে একটা জাহাজে করে পাকিস্তানিরা অনেক অস্ত্র এনেছে, সেই অস্ত্র বাঙালিরা নামাতে দিচ্ছে না। যশোর থেকে খুলনায় মিলিটারিদের একটা ট্রেন যাচ্ছিল, সেই ট্রেন বাঙালিরা আক্রমণ করে বসেছে। সারা দেশে যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।