নানির গালিগুলো খুবই শক্তিশালী, নিঃশ্বাস না ফেলে নানি টানা গালি দিয়ে যেতে পারে, শুনতে খুবই ভালো লাগে।
বাড়িতে মন টিকছিল না বলে ভাত খেয়ে আবার বের হলাম। দুপুরের উত্তেজনাটা একটু কমেছে, পার্লামেন্ট বন্ধ করে দেবার পর বঙ্গবন্ধু কী বলেন সবাই এখন সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি একা একা কাঁকনডুবি গ্রামের ভেতর হেঁটে বেড়ালাম। ঠিক কী কারণ জানি না ভেতরে ভেতরে একটু অস্থির লাগছিল।
.
পরের কয়েকটা দিন খুবই উত্তেজনার মাঝে কাটল। তার কারণ মাসুদ ভাই আমাদেরকে জানাল বাংলাদেশ প্রায় হয়েই গেছে। বাংলাদেশের একটা ফ্ল্যাগ তৈরি করা হয়েছে সেটা এখন সারা দেশে উড়ছে। নূতন একটা দেশ হলে ফ্ল্যাগের সাথে সাথে একটা জাতীয় সঙ্গীত লাগে, সেটাও হয়ে গেছে। আমার সোনার বাংলা বলে নাকি রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে, সেটা হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত। এত কষ্ট করে মাত্র পাক সার জমিন সাদ বাদ গানটা শিখেছি এখন আবার নূতন করে সোনার বাংলা গানটা শিখতে হবে! নীলিমা মনে হয় এখনই সেটা জানে। বাংলাদেশ যে হয়েই গেছে তার আরও প্রমাণ আছে, আগে বলত রেডিও পাকিস্তান ঢাকা এখন বলে ঢাকা বেতার কেন্দ্র। আমি মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম রেডিও বাংলাদেশ কেন বলে না, মাসুদ ভাই বলল যে এখনো বাংলাদেশের আসল ঘোষণাটা দেওয়া হয় নাই, সেই জন্য রেডিও বাংলাদেশ বলছে না। বঙ্গবন্ধু ৭ তারিখে ঢাকার রেসকোর্সের ময়দানে বাংলাদেশের ঘোষণা দেবেন তখন থেকে পুরোপুরি বাংলাদেশ হয়ে যাবে। আমার ভেতরে একই সাথে একধরনের আনন্দ উত্তেজনা আর ভয় কাজ করতে লাগল। যখন আশপাশে কেউ নেই তখন মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ৭ তারিখে বাংলাদেশের ঘোষণা দিলে মিলিটারিরা আক্রমণ করবে না? ইয়াহিয়া খান এমনি এমনি মেনে নেবে?
মাসুদ ভাই তখন প্রথমে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর একটু মাথা চুলকে বলল, মেনে নেওয়ার কথা না। কিন্তু পুরো দেশটা এখন চলছে বঙ্গবন্ধুর কথায়। সারা দেশে এখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা নাই। মিলিটারি কী করবে? তবে–
তবে কী?
দরকার হলে মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করার জন্যও সবাই রেডি হচ্ছে। সব জায়গায় ছেলেমেয়েরা যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে।
উত্তেজনায় আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল, জিজ্ঞেস করলাম, আমরা ট্রেনিং নেব না?
মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল, আমার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, যুদ্ধ হচ্ছে বড়দের ব্যাপার। বড়রা ট্রেনিং নেবে! তোমরা ছোট।
আমার একটু মন খারাপ হলো, মাসুদ ভাই আমাকে বিশ্বাস করছে না কিন্তু ঠিকই আমি ট্রেনিং নিতে পারব। লেখাপড়ায় আমি সুবিধা করতে পারি না কিন্তু দৌড়ঝাঁপ সাঁতার মারামারিতে আমার ধারে-কাছে কেউ নাই। যুদ্ধ তো এক রকম মারামারিই হাতে না করে বন্দুক দিয়ে করবে এই পার্থক্য।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বড়দের ট্রেনিং কি হবে?
চেষ্টা করছি। আমি তো মিলিটারি ট্রেনিং দিতে পারব না। মিলিটারি ট্রেনিং দিতে দরকার মিলিটারি মানুষ। শুনেছি পাশের এক গ্রামে একজন রিটায়ার্ড ইপিআর সুবেদার আছে তাকে নিয়ে আসব ভাবছি।
সব গ্রামে একজন পাগল একজন ফালতু মানুষ আর একজন গায়ক থাকে। কিন্তু সব গ্রামে রিটায়ার্ড ইপিআর সুবেদার থাকে না কোনো কোনো গ্রামে থাকে। আমাদের কাঁকনডুবিতে নাই।
আস্তে আস্তে আমাদের কাঁকনডুবিতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। মার্চের ৭ তারিখ বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়ে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ করে দেবেন সেই জন্য সবাই অপেক্ষা করে আছি। দেশের মানুষ অবশ্যি থেমে নেই, সব জায়গায় মিছিল করছে, পাকিস্তান মিলিটারি গুলি করে এখানে-সেখানে মানুষ মারছে। সেই জন্য বঙ্গবন্ধু রেগে আগুন হয়ে আছেন।
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে গিয়ে একদিন আরেকটা ভয়ংকর খবর পেলাম, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মানুষটা পাঞ্জাবি হলেও নাকি ভালোই ছিল এখন তাকে সরিয়ে সেখানে টিক্কা খান নামে একটা জল্লাদকে বসিয়েছে। এই জল্লাদ তাদের দেশে এত মানুষ গুলি করে মেরেছে যে তাকে নাকি কসাই টিক্কা বলে ডাকে।
বলাই কাকুর চায়ে চুমুক দিতে দিতে একজন বলল, টিক্কা খানের চেহারা নাকি জানোয়ারের মতো, চোখ দুইটা সব সময় লাল।
আরেকজন বলল, গায়ের রং নিশ্চয়ই কুচকুচে কালো তা না হলে নাম টিক্কা কিসের জন্য।
কথাটাতে যুক্তি আছে, গ্রামের মানুষ হুঁকো খাওয়ার সময় যে টিকেতে আগুন জ্বালায় সেটা আসলেই কুচকুচে কালো। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল।
আরেকজন বলল, তামুক খাওয়ার সময় টিক্কার পেছনে আমরা আগুন দিই না? এই টিক্কার পেছনেও আগুন দিয়ে তারে দেশ থেকে তাড়াতে হবে।
খুব ভালো একটা রসিকতা হয়েছে চিন্তা করে সবাই আনন্দে হা হা করে হাসল। আমাদের গ্রামের মানুষ খুবই সাদাসিধা ধরনের তারা অল্পতেই হাসে আবার অল্পতেই রেগে যায়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ তারিখের ভাষণটা রেডিওতে শোনাবে, সেই জন্য আমরা সেই দুপুর থেকে বলাই কাকুর চায়ের স্টলে হাজির হলাম। বলাই কাকু ছাড়াও যাদের বাড়িতে রেডিও আছে সেখানে সবাই ভিড় করল। ভাষণ শুরু হবার আগে একজন রেসকোর্সের বর্ণনা দিচ্ছে, সে বলল সেখানে নাকি কমপক্ষে বিশ লক্ষ মানুষ আছে। বিশ লক্ষ মানুষ! কী সাংঘাতিক ব্যাপার। এর আগে কি পৃথিবীর কোনো দেশে একটা ভাষণ শুনতে বিশ লক্ষ মানুষ হয়েছে? আকাশে হেলিকপ্টার উড়ছে। মিলিটারির হেলিকপ্টার, তাদের আবার কোনো বদ মতলব নাই তো?