বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর গান শুরু হলো। আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা কয়টা গান গাইল। আমাদের ক্লাসের নীলিমাও একটা গান গেয়ে শোনাল, সে যে গান গাইতে পারে, আমরা কেউই জানতাম না। সবার শেষে গান গাইল আমাদের আলাউদ্দিন চাচা–পকেট থেকে মুড়ি বের করে চিবুতে চিবুতে আমি গান শুনতে লাগলাম, কী সুন্দর সেই গান, সেটা আর বলে বোঝানো যাবে না।
সব মিলিয়ে আমাদের ছোট কাঁকনডুবি গ্রামের সেই একুশে ফেব্রুয়ারিটা ছিল বিশাল একটা ঘটনা। ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু আমাদের সবারই মনে হতে লাগল আমরা বুঝি একটুখানি হলেও বড় হয়ে গেছি। মনে হতে লাগল এই যে কাঁকনডুবি গ্রাম, এখানকার গাছপালা, নদী–রাস্তা তার বাইরেও বড় কিছু একটা আছে। দেশ কথাটা আগে কতবার শুনেছি, কিন্তু সেটা কী আগে বুঝতে পারিনি, কেন যেন মনে হতে লাগল দেশ ব্যাপারটা একটু একটু বুঝতে পারছি। কার সাথে এটা নিয়ে কথা বলা যায় আমি শুধু সেটা বুঝতে পারলাম না।
.
০৫.
সোমবার স্কুল থেকে বের হয়েই টের পেলাম কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কী হয়েছে সেটা বুঝতে পারলাম না। মানুষজনের মাঝে একধরনের উত্তেজনা, নিজেরা কথা বলছে এবং খুবই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ছে, আমরা ছোট বলে কেউ আমাদের পাত্তা দেয় না। তাই ব্যাপারটা কী ঘটেছে কেউ আমাদেরকে বলছে না। ইলেকশনের পর যখন নৌকা মার্কা বলতে গেলে সবগুলো সিট পেয়ে গেল সেই দিন সারা গ্রামের মানুষের মাঝে এ রকম উত্তেজনা ছিল–কিন্তু সেই উত্তেজনাটা ছিল আনন্দের উত্তেজনা। আজকের উত্তেজনাটা কেমন যেন রাগী রাগী উত্তেজনা–মনে হয় ঢাকা শহরে বড় কিছু ঘটে গেছে।
আমি আর মামুন তাড়াতাড়ি হেঁটে বলাই কাকুর চায়ের স্টলের দিকে রওনা দিলাম, আর কেউ কিছু আমাদের না বললেও বলাই কাকু নিশ্চয়ই আমাদের বলবে।
বলাই কাকুর চায়ের স্টলে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক ভিড়, বলাই কাকুর রেডিওটা চলছে আর সবাই খবর শোনার চেষ্টা করছে। মাসুদ ভাইও সেখানে আছে তার মুখটা কেমন জানি থমথম করছে, দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট, একটু পর পর সেটা টানছে।
ভিড় ঠেলে আমি মাসুদ ভাইয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাসুদ ভাই, কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই রাগী রাগী গলায় বলল, যেটা সন্দেহ করেছিলাম বদমাইসগুলি তাই করেছে।
কোন বদমাইশগুলি? কী করেছে?
পরশু দিন পার্লামেন্ট বসার কথা–ইয়াহিয়া খান আজকে বন্ধ করে দিয়েছে। সারা দেশে আগুন ধরে গেছে।
এখন কী হবে?
জানি না। বঙ্গবন্ধু হরতাল ডেকেছে।
বলাই কাকু কাঁপা গলায় বলল, রেডিও পাকিস্তানে কিছু বলে না, বিবিসি শুনতে হবে।
মাসুদ ভাই বলল, ফার্মগেটে মিলিটারি গুলি করে অনেক পাবলিক মেরে ফেলেছে।
একজন বলল, কত বড় সাহস।
বলাই কাকু বলল, শুধু ঢাকাতে না, খুলনা, যশোর, চিটাগাং সব জায়গায় গোলাগুলি হয়েছে। কারফিউ দিয়ে রেখেছে।
কারফিউ কথাটা শুনলেই ভয় লাগে। কারফিউয়ের সময় বের হলেই গুলি। কী ভয়ানক।
মাসুদ ভাই মাথা নেড়ে বিড়বিড় করে বলল, এটা হতে পারে না, কিছুতেই হতে পারে না।
বলাই কাকুর চায়ের দোকানে তখন সবাই কথা বলতে লাগল, টেবিলে থাবা দিতে লাগল। বলাই কাকু চিন্তিত মুখে চা বানাতে লাগলেন, টেবিলে টেবিলে চা দিতে লাগলেন। আজকে আর আমাদের ফ্রি চা খাওয়ার কোনো আশা নাই, আমরা তাই আর অপেক্ষা না করে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাড়িতে এসে দেখি নানি উঠান ঝাড় দিচ্ছে। মানুষ বুড়ো হলে শুয়ে বসে থাকে, একটু আরাম করার চেষ্টা করে। নানি হচ্ছে তার উল্টো, সারাক্ষণই কাজ করছে–যখন কোনো কাজ থাকে না তখনো কীভাবে কীভাবে জানি কাজ আবিষ্কার করে ফেলে। আমাকে দেখে নানি অবাক হবার ভান করে বলল, কী ব্যাপার! আজকে লাট সাহেব এত তাড়াতাড়ি বাড়িতে? ব্যাপারটা কী?
আমি মুখ গম্ভীর করে বললাম, নানি, দেশে খুব বড় বিপদ।
কী বিপদ?
ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্ট বন্ধ করে দিয়েছে।
কী বন্ধ করে দিয়েছে?
পার্লামেন্ট।
সেইটা আবার কী?
সেইটা কী, আমি নিজেও জানি না তাই আলাপটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, বললাম, বঙ্গবন্ধু খুবই রাগ, হরতাল ডেকেছেন।
হরতাল আবার কী?
হরতাল জিনিসটা কী আমরা শিখে গেছি, তাই নানিকে বোঝালাম, হরতালের সময় কোনো গাড়ি-ঘোড়া চলে না, দোকানপাট খোলে না, সবকিছু বন্ধ থাকে–
নানির মুখে যা একটু দুশ্চিন্তার ভাব এসেছিল এবারে সেটা পুরোপুরি কেটে গেল। বলল, আমাগো কাঁকনডুবিতে গাড়ি-ঘোড়াও নাই, দোকানপাটও নাই, হরতাল হলে কী আর না হলেই কী?
নানি আবার উঠান ঝাড় দিতে যাচ্ছিল তখন আমি বললাম, সারা দেশে কারফিউ। মিলিটারি গুলি করে অনেক মানুষ মারছে। অনেক গোলমাল।
এইবারে নানির মুখের মাঝে একটা দুঃখের ছায়া পড়ল। একটু মাথা নেড়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আহারে। কার বুকের ধন, কে জানি কাইড়া নিল! ইশ রে!
আমি বইগুলো ঘরের ভেতর বিছানার উপরে রেখে বাইরে এলাম। নানি আবার গভীর মনোযোগ দিয়ে উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। ঝাড়ু দিতে দিতে কথা বলছে, একা একা যতক্ষণ ছিল কথা বলে নাই, এখন আমি এসেছি আর সাথে সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। এখন কথাগুলো হচ্ছে অভিশাপ আর গালি, যে মিলিটারিগুলো গুলি করে দেশের মানুষ মারছে তাদেরকে গালি, তোরা মর। তোরা গুষ্টি নিয়ে মর। মরে নির্বংশ হ। মুখে রক্ত উঠে মর–মরে দোজখে যা, জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মর–