মাসুদ ভাই খুব ব্যস্ত হয়ে ঘোরাঘুরি করছিল, আমাকে দেখে বলল, রঞ্জু, এসেছ। এই যে কালো ব্যাজ, সবাইকে লাগিয়ে দাও দেখি।
কালো ব্যাজ কেন পরতে হবে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মাসুদ ভাই নিজে আমাকে এত বড় কাজ দিয়েছে, গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল। আমি আমার ফুলগুলো বগলে চেপে মাসুদ ভাইয়ের হাত থেকে অনেকগুলো কালো ব্যাজ আর আলপিন নিয়ে সবার বুকে লাগানো শুরু করলাম।
আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে আলো ফুটে উঠতে লাগল, স্কুলের আরো ছেলেরা আসতে শুরু করল। শুধু ছেলেরা নয়, স্কুলের কয়েকজন মেয়েও চলে এসেছে, আমি নীলিমাকেও দেখতে পেলাম।
মাসুদ ভাই তখন আমাদের সবাইকে দুই লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। লাইনের সামনে আলাউদ্দিন চাচা তার সাথে আরো কয়েকজন, মাসুদ ভাই এই কয়েক দিন তাদের গান শিখিয়েছে। আলাউদ্দিন চাচা তখন তার মোটা গলায় গাইতে শুরু করল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি! গানটা খুবই সোজা ঘুরেফিরে এই দুইটা লাইনই গাইতে হয় তাই একটু পরে আমরাও যোগ দিলাম, আমাদের গলায় কোনো সুর নাই কিন্তু তাতে সমস্যা কী?
আমাদের স্কুল খুবই কাছে কিন্তু মাসুদ ভাই আমাদেরকে নিয়ে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল, পুরো গ্রাম ঘুরে এসে তারপরে আমাদের স্কুলের শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হবে। খুবই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা সবাই ফুলগুলো হাতে ধরে রেখে আস্তে আস্তে হাঁটছি। যে যে রকম পারি সে রকম আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি গাইছি। আমার পাশেই মামুন সে হঠাৎ গান থামিয়ে আমাকে ডাকল, এই রঞ্জু।
কী?
তুই ফুল না এনে গাছের পাতা এনেছিস কেন?
আমি আমার হাতের দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি আমার হাতে কোনো ফুল নাই, শুধু কিছু পাতা। অন্ধকারে ফুল মনে করে আমি কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে এনেছি! আমি এদিক-সেদিক তাকালাম, সবার হাতেই কোনো না কোনো ফুল, শুধু আমার হাতে গাছের পাতা! নিজেকে বেকুবের মতো লাগছিল কিন্তু কী আর করব, শুধু গাছের পাতা নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। পাজি মামুনটা ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলতে লাগল, দেখ দেখ। রঞ্জুটা কী গাধা, ফুল না এনে কয়েকটা গাছের পাতা নিয়ে এসেছে। সবাই আমাকে দেখে হি হি করে হাসতে লাগল, আমি শুধু গম্ভীর হয়ে বললাম, ভালো হবে না কিন্তু। শহীদ দিবসে হাসাহাসি করছিস তোদের লজ্জা করে না? মাসুদ ভাইকে বলে দেব কিন্তু।
শহীদ দিবসে হাসাহাসি করা ঠিক হবে না ভেবে তখন সবাই অবশ্যি হাসাহাসি থামিয়ে মুখ গম্ভীর করে ফেলল।
আমরা গ্রামের সড়ক ধরে একেবারে শেষ পর্যন্ত গিয়ে হিন্দুপাড়াটা ঘুরে ফিরে এলাম। আমাদের গান শুনে সবাই বাড়ির ভেতর থেকে বের হতে লাগল। বাড়ির বউ-ঝিরা উঁকি দিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। মজা দেখার জন্য ছোট ছোট বাচ্চারা আমাদের সাথে সাথে হাঁটতে লাগল। অনেকেই আমাদের প্রভাতফেরিতে যোগ দিতে লাগল। ফালতু মতির বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় আমরা মতিকে দেখলাম, সে একটা দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি ধরে রেখে তাদের বাংলাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি যখন মতির দিকে তাকালাম তখন মতি পিচিক করে মাটিতে থুতু ফেলল। আমরা যখন লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম লতিফা বুবুও বাড়ির ভেতর থেকে বাইরে এসে অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দেখে লতিফা বুবু হাত নাড়ল, আমরাও তখন জোরে জোরে হাত নাড়তে থাকলাম।
আমাদের প্রভাতফেরি যখন আমাদের স্কুলের শহীদ মিনারে এসে পৌঁছেছে তখন বেশ রোদ উঠে গেছে। শহীদ মিনারটাকে চুনকাম করে সাদা রং করা হয়েছে, ঠিক মাঝখানে লালসালু দিয়ে তৈরি গোল সূর্য। আসল শহীদ মিনার আমি দেখি নাই কিন্তু আমাদেরটা থেকে সেটা বেশি সুন্দর হবে বলে মনে হয় না।
শহীদ মিনারে গিয়ে সবাই একে একে ফুল দিতে লাগল। আমার হাতে ফুল নাই শুধু গাছের পাতা, তাই আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাসুদ ভাই তখন শহীদ মিনারের বেদিতে আলাউদ্দিন চাচা আর অন্যদের বসার ব্যবস্থা করছিল, আমি তখন তার সাথে কথা বলার ভান করে বেদিতে উঠে খুবই সাবধানে আরেকজনের দেওয়া কয়েকটা ফুল তুলে নিলাম। একই দিনে দ্বিতীয়বার চুরি করতে হলো–মহৎ কাজে ছোটখাটো চুরিচামারি করলে কোনো দোষ হয় না।
তবে সমস্যা হলো মামুনকে নিয়ে, আমি যখন ফুল হাতে নিয়ে বেদির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন সে চিৎকার করে উঠল, এই রঞ্জু। তুই এই ফুল কোথায় পেয়েছিস? নিশ্চয়ই চুরি করেছিস?
আমি বললাম, খবরদার কথা বলবি না। চুপ করে থাক। না হলে দাঁত ভেঙে দেব।
মামুন চুপ করে থাকত কি না জানি না, কিন্তু শহীদ দিবসে ঝগড়া করা ঠিক হবে না মনে করেই হয়তো শেষ পর্যন্ত চুপ করে রইল।
মাসুদ ভাই আমাদের সবাইকে শহীদ মিনারের সামনে বসিয়ে দিল। স্কুলের স্যারেরা বেদির উপরে বসলেন, তারপর বক্তৃতা শুরু হলো। স্যারদের বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাস নাই তাই যার যা কিছু মনে আসে বলে গেলেন। চিকা স্যারের বক্তৃতাটা আমরা সবাই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলাম, শুনলাম বলা ভুল হবে, বলা উচিত দেখলাম। তার কারণ বক্তৃতা দিতে দিতে স্যার কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলেন, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল, মুখে কেমন যেন ফেনা জমে গেল এবং স্যার কেমন যেন মৃগী রোগীর মতো কাঁপতে শুরু করলেন। তখন অন্য কয়েকজন স্যার চিকা স্যারকে টেনে এনে বসিয়ে দিলেন। চিকা স্যার বসে থেকেই কেমন যেন তিরতির করে কাঁপতে থাকলেন। সবার শেষে বক্তৃতা দিলেন মাসুদ ভাই, বক্তৃতাটা পুরো বুঝতে পারলাম না, দেশের খুব বড় ঝামেলা হচ্ছে, সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কিছু একটা করে ফেলতে হবে, এ রকম কিছু কথা বলল কিন্তু কী করতে হন্ধে আমরা বুঝতে পারলাম না।