নানি মুখের মাঝে একটা পান ঢুকিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, তুই সকালে ঘুম থেকে উঠবি? এই কথা তুই আমারে বিশ্বাস করতে বলিস? বেলা হওয়ার পরেও তোরে ঠেলা দিয়ে ঘুম থেকে তোলা যায় না–তুই উঠবি অনেক সকালে!
নানি কালকে প্রভাতফেরিতে যেতে হবে–একেবারে অন্ধকার থাকতে প্রভাতফেরি শুরু হবে।
নানি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, তোরা কি চোর নাকি যে অন্ধকার থাকতে বের হবি?
আমি বললাম, নানি কালকে একুশে ফেব্রুয়ারি, শহীদ মিনারে ফুল দিতে হবে।
ফুল দিলে দিবি। তয় অন্ধকারে কেন?
সেইটা আমি জানি না। যেটার যে নিয়ম।
ফুল পাবি কই?
আমাদের কাঁকনডুবি গ্রামে কেউ ফুলগাছ লাগায় না। বনে জঙ্গলে কিছু জংলি ফুল আছে। কাজীবাড়ির সামনে কিছু ফুলগাছ আছে, বিকেল বেলা দেখে এসেছি। অন্ধকার থাকতে বের হওয়ার সেইটাই হচ্ছে আসল কারণ, সেখান থেকে ফুল চুরি করতে হবে। মহৎ কাজের জন্য এই রকম ছোটখাটো চুরিচামারি করলে দোষ হয় না। নানিকে অবশ্যি সেইটা বললাম না, হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করলাম।
বিছানায় ঢুকে কাঁথা গায়ে দিয়ে নানিকে বললাম, মনে আছে তো নানি? একেবারে শেষরাতে তুলে দেবে?
নানি বলল, মনে আছে।
ঘড়ির টাইমে সকাল পাঁচটা।
নানি দাঁত বের করে হাসল, কাঁকনডুবি গ্রামে কারো বাড়িতে কোনো ঘড়ি নাই! আমরা কেউ ঘড়ির সময়ে চলি না। তাই সকাল পাঁচটার কোনো অর্থ নাই!
ভোর রাতে সত্যি সত্যি নানি আমাকে তুলে দিল। সকালে ঘুম থেকে ওঠা আমার জন্য খুবই কঠিন একটা কাজ কিন্তু আজকে চট করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জানালার ঝাপিটা সরিয়ে বাইরে তাকালাম অন্ধকার কেটে ফরসা হতে শুরু করেছে। আমি তখন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম। দেরি করা ঠিক হবে না, আলো হয়ে গেলে ফুল চুরি করা কঠিন হয়ে যাবে।
আমি বালিশের নিচে ভাজ করে রাখা শার্টটা পরে নানিকে বললাম, নানি আমি গেলাম।
গেলি মানে কী? মুখে চাইরটা ভাত দিয়া যা।
না নানি। ভাত খাওয়ার সময় নাই।
হাত-মুখ ধুয়ে যা।
মসজিদের সামনে কলের পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নেব।
একটু মুড়ি খেয়ে যা–খিদা লাগবে তো।
দেও দেও নানি। তাহলে মুড়ি দেও তাড়াতাড়ি।
আমি অবশ্যি মুড়ি খেয়ে সময় নষ্ট করলাম না, দুই পকেট ঠেসে মুড়ি ভরে নিলাম, যেতে যেতে খাওয়া যাবে। ঘর থেকে বের হবার সময় নানি হাতে একটা কলা ধরিয়ে দিল।
আবছা অন্ধকারে আমি ছুটতে ছুটতে কাজীবাড়িতে হাজির হলাম। এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা সবাই দেশবিদেশে থাকে। বাসায় বেশি মানুষ নাই–যারা আছে তাদের কেউ নিশ্চয়ই এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেনি কিন্তু আমি যেই বাড়ির সামনে বেড়াটা টপকে ভেতরে ঢুকেছি, তখনই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। আমি কুকুরের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম–ডাকাডাকি করে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিলেই সমস্যা। আমি চাপা গলায় তু তু করে কুকুরটাকে ডাকলাম, সে তখন খুব ভালো মানুষের মতো লেজ নাড়তে নাড়তে আমার কাছে এগিয়ে এল, আমি তখন তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলাম। কাঁকনডুবি গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে– মানুষকেও চেনে,গরু-ছাগল-কুকুরকেও চেনে।
আমি সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি ডাঁটাসহ কয়েকটা ফুল ভেঙে নিলাম, অন্ধকারে ফুলের রং বোঝা যায় না কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। শহীদ মিনারে কী রঙের ফুল দেয়া যায় তার নিশ্চয়ই কোনো নিয়ম নাই। কুকুরটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল, তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় সে ফুল চুরির ব্যাপারে আমাকে আরো সাহায্য করতে পারছে না বলে লজ্জিত এবং দুঃখিত!
আমি দেরি না করে ফুলগুলো হাতে নিয়ে আবার ছুটতে থাকি, কুকুরটা আমাকে সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসে। সড়কটাতে উঠে পকেট থেকে এক খাবলা মুড়ি বের করে চিবুতে লাগলাম। হিন্দুপাড়ার মুড়ি, খুবই মচমচে। খাওয়ার আগে দাঁত মেজে হাত-মুখ ধুয়ে নেয়ার কথা, একদিন পরের কাজটা আগে আর আগের কাজটা পরে করলে কোনো দোষ নাই। সড়কটাতে কোনো মানুষজন নাই, মসজিদের কাছে এসে কয়েকজন মুসল্লিকে পেলাম, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি যাচ্ছে। আমাকে দেখে একজন জিজ্ঞেস করল, এইটা কেডা? রঞ্জু না?
আমি বললাম, জি চাচাজি।
এত সকালে কই যাস?
প্রভাতফেরিতে।
সেইটা আবার কী জিনিস?
প্রভাতফেরি বিষয়টা কেমন করে বোঝাব চিন্তা করছিলাম। তখন পাশের মানুষটা বুঝিয়ে দিল, পোলাপানের কাম। স্কুলে মনে হয় ভ্যারাইটি শো হবি, তাই না রে?
আমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে এগিয়ে গেলাম। এই মুরব্বিদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন। মসজিদের সামনে টিউবওয়েলের পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে আমি আবার স্কুলের দিকে রওনা দিলাম। স্কুলের কাছাকাছি এসে দেখি এর মাঝে অনেকেই হাজির হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে সবাইকে চেনা যায় না, শুধু আলাউদ্দিন চাচাকে চিনতে পারলাম। একটা গ্রামে যে রকম একজন পাগল থাকে আর একজন ফালতু মানুষ থাকে ঠিক সে রকম একজন গায়কও থাকে। আলাউদ্দিন চাচা আমাদের কাঁকনডুবির গায়ক। তার লম্বা ঝাঁকড়া চুল সেই চুলে ঝাঁকুনি দিয়ে যখন গানে টান দেয় সবাই তখন টাশকি মেরে যায়। আলাউদ্দিন চাচা কালী গাংয়ে খেয়া পারাপার করে। নিশুতি রাতে আমরা শুনি কালী গাংয়ের মাঝখান থেকে আলাউদ্দিন চাচা গান ধরেছে। আলাউদ্দিন চাচার সংসারে মন নাই, সেই জন্য বাড়িতে খুব অশান্তি। আজকে অবশ্যি আলাউদ্দিন চাচার ভাবভঙ্গিতে কোনো অশান্তির চিহ্ন নাই, একটা হারমোনিয়াম গামছা দিয়ে বেঁধে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়েছে, তার মাঝে খুবই উৎসাহ, দেখে মনে হয় আলাউদ্দিন চাচা অনেক দিন পরে একটা মনের মতো কাজ পেয়েছে।