ফালতু মতির মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম সে শহীদ মিনার বানানোর খবর পেয়ে গেছে কিন্তু ভান করছে আমাদের মুখ থেকে প্রথম শুনছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী বানাচ্ছিস?
শহীদ মিনার।
সেইটা আবার কী বস্তু? কী হবে এইটা দিয়ে?
মামুন বলল, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে ফুল দেব।
ফুল দিবি? মুসলমানের বাচ্চা ফুল দিবি মানে?
আমি আর মামুন একজন আরেকজনের মুখে তাকালাম। মামুন জিজ্ঞেস করল, ফুল দিলে কী হয়?
গুনাহ হয়। মুসলমানের বাচ্চা ফুলটুল দেয় না। ফুল দেয় মালাউনের বাচ্চারা। তোরা কি মালাউন?
ফালতু মতি হিন্দুদের হিন্দু না বলে মালাউন ডাকে। কেন ডাকে জানি না। আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না তাই চুপ করে থাকলাম। মতি বলল, এই সব কামকাজ ওই নূতন মাস্টারের। লেখাপড়া নাই কোনো পাস নাই তারে স্কুলের মাস্টার বানাইছে আর সেই চ্যাংড়া মাস্টার স্কুলের পোলাপানদের নিয়া রাজনীতি করে? স্কুলে শহীদ মিনার বানায়? কত বড় সাহস। আমি আজকেই নালিশ দিমু। লিখিত নালিশ।
আমি বললাম, নালিশ দিয়ে লাভ নাই মতি ভাই। এখন সব স্কুলে শহীদ মিনার থাকে। সারা দেশ এখন জয় বাংলা।
সারা দেশে কী?
জয় বাংলা।
মতি কী রকম যেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। জয় বাংলা কথাটা শুনে মনে হয় কেমন জানি টাশকি মেরে গেল!
আমি আর মামুন আর না দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটতে শুরু করলাম। খানিক দূর গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি মতি উল্টো দিকে হাঁটছে। লতিফা বুবুর বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নাই। এই রকম মানুষ আমরা জন্মেও দেখি নাই।
স্কুলে গিয়ে দেখি হুলুস্থুল অবস্থা। অনেক ছেলে এসেছে। মেয়েদের মাঝে খালি নীলিমা। বড় বড় বাঁশ আনা হয়েছে। আমাদের গ্রামের কাঠমিস্ত্রী কালীপদ করাত দিয়ে সেই বাঁশ কাটছে। কয়েকজন মিলে মাটি কেটে স্কুলের এক কোনায়া উঁচু করে একটা ভিটে মতন তৈরি করছে। তার মাঝে মাসুদ ভাই কানে একটা কাঠপেন্সিল লাগিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
আমরা পৌঁছাতেই মাসুদ ভাই আমাদের কাজে লাগিয়ে দিল, স্কুলের পেছনে একটা দেয়াল ধসে পড়েছে, সেখানে অনেক ইট খুলে পড়েছে। মাসুদ ভাই আমাদেরকে ইট আনতে লাগিয়ে দিল। আমরা মহা উৎসাহে ভাঙা দেয়াল থেকে টেনে টেনে ইট আনতে লাগলাম।
বিকেলের মাঝে শহীদ মিনারটা দাঁড়িয়ে গেল। মিনার শব্দটার জন্য আমি ভেবেছিলাম ওপরে হয়তো গম্বুজের মতো কিছু একটা থাকবে। কিন্তু দেখা গেল সে রকম কিছু না। অনেকটা মইয়ের মতন, শুধু মইয়ের কাঠিগুলো আড়াআড়ি না হয়ে লম্বা লম্বি। মাঝখানে দুইটা, তার দুই পাশে একটু ছোট আরো দুইটা। শহীদ মিনার বানানো এত সোজা জানলে আমরা নিজেরাই বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
শহীদ মিনার শেষ করার পর মাসুদ ভাই একটু দূর থেকে শহীদ মিনারটা দেখে তৃপ্তির একটা শব্দ করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এইটাই শহীদ মিনার?
মাসুদ ভাই একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে বলল, এইটা আমাদের শহীদ মিনার। একেক জায়গায় একেক রকম শহীদ মিনার হয়। পিলারগুলো একটু চিকন হয়েছে, মোটা হলে আরেকটু ভালো হতো।
মামুন জিজ্ঞেস করল, এখন কী করব?
একুশে ফেব্রুয়ারির দিন প্রভাতফেরি করে ফুল দেব।
আর কিছু করব না?
বাঁশগুলো সাদা রং করতে হবে। পেছনে একটা লাল সূর্য দরকার। বাজার থেকে লালসালু কিনে আনতে হবে।
আমরা যখন চলে আসছিলাম তখন মাসুদ ভাই আমাদের থামাল, তারপর তার ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটা মোটা বই বের করে আমাদের হাতে দিয়ে বলল, নাও। এই বইটা তোমাদের লতিফা বুবুর জন্য। পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে কিন্তু।
আমি বইটা হাতে নেওয়ার আগেই মামুন খপ করে বইটা নিয়ে নিল, বলল, দেব মাসুদ ভাই। বইটা ফেরত দেব।
স্কুল থেকে বের হয়ে সড়কটার উপরে উঠতেই মামুন এদিক-সেদিক তাকিয়ে বইটা খুলে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খুজঁতে থাকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী খুজছিস? .
চিঠি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কার চিঠি?
বেকুব কোথাকার! তুই জানিস না বইয়ের ভেতর দিয়ে চিঠি চালাচালি হয়?
মামুন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও অবশ্যি ভেতরে কোনো চিঠি খুঁজে পেল না। মনে হলো সে জন্য খুবই বিরক্ত হলো।
.
লতিফা বুবু বইটা পেয়ে খুবই খুশি হলো। আমরা কোথা থেকে বইটা পেয়েছি জানতে চাইল, আমরা তখন মাসুদ ভাইয়ের কথা বললাম। মাসুদ ভাই যে শহীদ মিনার তৈরি করেছেন সেটাও বললাম, শহীদ মিনার যে কয়েকটা বাঁশের খাম্বা পুঁতে তৈরি করা হয়েছে সেটা অবশ্যি আর বললাম না! শহীদ মিনারের কথা শুনে লতিফা বুবু খুবই কৌতূহলী হয়ে উঠল। বলল, আমাকে দেখাবি?
তুমি যাবে? স্কুলের মাঠের কোনায় তৈরি, এখনো রং দেওয়া হয় নাই। রং দিলে একেবারে চিনতেই পারবে না।
কী রং দিবি?
মামুন গম্ভীর হয়ে বলল, সাদা। শহীদ মিনার সব সময় সাদা হয়।
আমি বললাম, তুমি যদি যেতে চাও একুশে ফেব্রুয়ারিতে তোমাকে নিয়ে যেতে পারি। খালি পায়ে যেতে হবে কিন্তু। প্রভাতফেরিতে সব সময়ে খালি পায়ে যেতে হয়।
খালি পা লতিফা বুবুর জন্য সমস্যা না–খালা-খালু হচ্ছে সমস্যা। খালা-খালু লতিফা বুবুকে এখন ঘর থেকেই বের হতে দেয় না।
একুশে ফেব্রুয়ারি যতই এগোতে লাগল আমাদের উত্তেজনা ততই বাড়তে লাগল। যাদের গানের গলা আছে তাদেরকে নিয়ে মাসুদ ভাই প্রভাতফেরির গান শেখাতে লাগল। মাসুদ ভাই কীভাবে কীভাবে জানি স্কুলের স্যারদেরকেও প্রভাতফেরি করতে রাজি করিয়ে ফেলেছে। পুরনো খবরের কাগজের ওপর কালো কালিতে একুশে ফেব্রুয়ারির উপর পোস্টার লেখা হলো, আমরা সেগুলো সারা গ্রামে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলাম। সেই ইলেকশনের সময় গ্রামে একটু হইচই হয়েছিল তারপর এতদিনে আর কিছু হয় নাই। তাই গ্রামের লোকজন মনে হয় বেশ আগ্রহ নিয়েই ব্যাপারটা দেখল। তা ছাড়া বঙ্গবন্ধু ইলেকশনে সবগুলো সিট পাওয়ার পর সারা দেশেই একটু জয় বাংলা জয় বাংলা ভাব। আমাদের কাঁকনডুবিতেও একই অবস্থা। বিশ তারিখ রাত্রি বেলা ঘুমানোর আগে আমি নানিকে বললাম, নানি আমাকে খুব সকালে ঘুম থেকে তুলে দিবা।