- বইয়ের নামঃ গ্রামের নাম কাঁকনডুবি
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ তাম্রলিপি
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. স্কুল ছুটির পর
প্রথম পর্ব
০১.
স্কুল ছুটির পর আমি আর মামুন কালী গাংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিলাম। বটগাছের কাছে এসে সড়কটা যেখানে পুব দিকে মোড় নিয়েছে, ঠিক সেখানে বলাই কাকুর চায়ের স্টল। বলাই কাকু মনে হয় সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ভালো চা বানায়–তার একটা দোমড়ানো মোচড়ানো কেতলি আছে, সেখানে পানি গরম করলেই চায়ের লিকার বের হয়, সেটা গ্লাসে ঢেলে তার মাঝে যখন ঘন দুধ আর চিনি দিয়ে বলাই কাকু আচ্ছা মতন ঘুঁটে দেয়, তখন তার যা একটা স্বাদ হয়, সেটা বলার মতো না। চা খাওয়ার জন্য নগদ পয়সা আমাদের কারোরই থাকে না–কিন্তু যদি চায়ের স্টলে খরিদ্দার না থাকে তাহলে বলাই কাকু আমাদের ছোট ছোট গ্লাসে হাফ কাপ ফ্রি চা বানিয়ে দেয়। আমাদের জন্য দুধ-চিনি বেশি করে দেয়। তাই বাড়ি যাবার সময় আমরা প্রত্যেক দিনই বলাই কাকুর চায়ের স্টলে একটু উঁকি দিয়ে যাই।
আজকে উঁকি দেওয়ার আগেই শুনলাম ভেতরে কোনো একজন উঁচু গলায় কথা বলছে। গলার স্বরটা অপরিচিত, তাই স্টলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। শার্ট-প্যান্ট, চোখে চশমা, হাতে সিগারেট কমবয়সী একজন মানুষ হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে, কী বলছে আমরা ভালো করে শুনতে পাচ্ছিলাম না। তার পরেও বুঝে গেলাম নিশ্চয়ই রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে। ইলেকশনের পর থেকে সবাই সব সময় আজকাল রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। চশমা চোখের কমবয়সী মানুষটার সামনে আমাদের গ্রামের দুইজন মুরব্বি বসে আছে। তারা সব কথা বুঝে ফেলছে, সেই রকম ভান করে মাথা নাড়ছে, কিন্তু তাদের মুখ দেখেই বুঝে গেলাম তারা আসলে কিছুই বুঝতে পারছে না। হালচাষ, গরু-ছাগল ছাড়া তারা কিছুই বোঝে না।
চশমা চোখের কমবয়সী মানুষটাকেও আমরা চিনতে পারলাম না। আমাদের কাঁকনডুবি গ্রামের মানুষ না–কাঁকনডুবি গ্রামের সবাইকে আমরা চিনি। শুধু মানুষ না এই গ্রামের সব গরু-ছাগলকেও আমরা চিনি। এই মানুষটা অন্য জায়গা থেকে এসেছে, দেখে মনে হয় শহর থেকে এসেছে। শহরের মানুষদের দেখলেই চেনা যায়, তারা অন্য রকম করে চুল কাটে। তা ছাড়া গ্রামের মানুষদের চোখে কখনো চশমা থাকে না।
আমি মামুনকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম–মানুষটা কে?
আমি যেহেতু চিনি না তাই মামুনেরও চেনার কথা না, কিন্তু মামুন আমার থেকে অনেক বেশি খবর রাখে। মানুষটাকে না চিনলেও কোথা থেকে এসেছে, কেন এসেছে সেটা জানতেও পারে। কিন্তু সেও চিনল না, মাথা নেড়ে বলল, চিনি না। আগে দেখি নাই।
কোনো বাড়িতে আসছে মনে হয়?
মনে হয় কোনো বাড়িতে আসে নাই।
তাহলে?
মামুন দাঁত বের করে হাসল, বলল, মনে হয় বিয়া করতে আসছে। কাঁকনডুবির জামাই।
জামাই?
মামুনের বুদ্ধি অনেক বেশি, এই সব বিষয় সে খুব ভালো অনুমান করতে পারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাকে বিয়ে করবে?
মামুন মুখ টিপে হাসল, বলল, মনে হয় লতিফা বুবুকে।
লতিফা বুবু ছিল আমাদের লিডার, যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা সবাই লতিফা বুবুর পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াতাম। লতিফা বুবু লেখাপড়াতেও খুব ভালো ছিল, আমাদের থেকে দুই ক্লাস উপরে পড়ত কিন্তু যখন একটু বড় হয়ে গেল তখন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের মেয়েরা যখন ছোট থাকে তখন স্কুলে যায়, যখন একটু বড় হয়। তখন তাদের লেখাপড়া বন্ধ করে তাদের বিয়ে দিয়ে দেয়। লতিফা বুবুর বিয়ের কথা হচ্ছে, মামুন মনে হয় ঠিকই বলেছে। এই চশমা পরা মানুষটা মনে হয় লতিফা বুবুকেই বিয়ের জন্য এসেছে। লতিফা বুবু যখন ছোট ছিল, আমাদের নিয়ে জঙ্গলে–মাঠে ঘুরে বেড়াত তখনই তার চেহারা খুব ভালো ছিল, এখন চেহারা আরো ভালো হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হয় না তাই বেশি দেখা হয় না কিন্তু যখন দেখা হয় তখন তাকে চিনতেই পারি না। শাড়ি পরলেই মেয়েরা অন্য রকম হয়ে যায়।
বলাই কাকুর চায়ের স্টল থেকে বের হয়ে আমরা আবার সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে আমাদের গ্রামের ভেতর ঢুকে গেলাম। সড়কটা গ্রামের ঠিক মাঝখান দিয়ে গিয়েছে, দুই পাশে ছোট ছোট বাড়ি, বাড়ির সামনে গাছপালা, বড় বড় বাঁশঝাড়। বাড়ির বাইরে গরু বেঁধে রেখেছে, গরুগুলো খুবই শান্ত ভঙ্গিতে খড় চিবিয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে কেমন যেন শান্তি শান্তি ভাব, মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় মানুষের থেকে বুঝি এই গরুদের মনেই শান্তি বেশি! অনেক মানুষ আছে তাদের মানুষ না হয়ে গরু হয়ে জন্ম হলেই মনে হয় ভালো ছিল।
সড়কের নরম ধুলায় পা ডুবিয়ে হাঁটতে কী মজাই না লাগে। জুতো জিনিসটা আবিষ্কার হয়েছে কেন, কে জানে? জুতো পরে এই নরম ধুলার মাঝে হাঁটার মধ্যে কি কোনো মজা আছে? তারপর যখন বৃষ্টির সময় আসবে তখন এই সড়কে যে কাদা হবে সেই কাদার মাঝে কার বাবার সাধ্যি আছে জুতো পরে হাঁটবে? মনে হয় সেই জন্যই কাঁকনডুবি গ্রামে জুতো–স্যান্ডেল পরে সে রকম মানুষ বলতে গেলে কেউ নাই।
আমি আর মামুন গল্প করতে করতে গ্রামের মাঝামাঝি চলে এলাম, মামুন তখন তার বাড়িতে ঢুকে গেল। বাকি পথটা ধীরে-সুস্থে একা একা হেঁটে আমি আমার বাড়িতে এসে উঠানে মাত্র পা দিয়েছি, তখনই নানি চিৎকার করতে শুরু করল। আমার মনে হয় সারা কাঁকনডুবিতে নানির মতো আর কারো গলায় জোর নাই।