আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হচ্ছে গাব্বু? পানির গ্লাসে দুধ ঢালছিস কেন?”
গাব্বু দুধ মেশানো পানির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, “দুধ হচ্ছে কলয়েড। পানিতে যদি একটু দুধ মেশাও তা হলে পানিতে দুধের কণাগুলো ভাসতে থাকে।”
“তোর দুধের কণা পানিতে ভাসানোর কথা না, দুধ খাওয়ার কথা।”
গাব্বু আম্মুর কথা শুনল বলে মনে হল না, অনেকটা নিজের মনে বলল, “এখন যদি এই দুধ মেশানো পানির ভেতর দিয়ে সাদা আলো দেওয়া হয় তা হলে কী হবে জানো?”
মিঠু জানতে চাইল, “কী হবে?”
“সাদা আলোর নীল অংশটা বিচ্ছুরণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। এর ভেতর দিয়ে যে আলোটা আসতে পারবে তার রং হবে লাল।”
মিঠু অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “একশ ভাগ সত্যি। এটার নাম র্যালে স্ক্যাটারিং। র্যালে স্ক্যাটারিংয়ের জন্যে সন্ধ্যাবেলা সূর্যকে লাল দেখায়, দিনের বেলা আকাশকে নীল দেখায়।”
মিঠু বলল, “সাদা আলো লাল করে দেখাও দেখি।”
গাব্বু এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “সেটা দেখানোর জন্যে দরকার সাদা আলো। একটা ছোট আয়না দিয়ে রোদটাকে এর মাঝে ফেললে–”
আব্বু বললেন, “গাব্বু, তোকে এখন স্কুলে যেতে হবে। এখন আয়না দিয়ে পানির গ্লাসে রোদ ফেলার সময় না।
আম্মু বললেন, “সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করে এখন নাস্তা শেষ করে আমাকে উদ্ধার কর।”
গাব্বু মুখ গোঁজ করে বলল, “তোমরা কেউ আমাকে কখনো কোনো এক্সপেরিমেন্ট করতে দাও না।”
টুনি বলল, “আউল-ফাউল কথা বলবি না। তুই কবে আমাদের কোন কথাটা শুনিস? তোর এক্সপেরিমেন্টের জ্বালায় এই বাসায় কেউ শান্তিতে এক মিনিট থাকতে পারে? তুই কখনো কারও কোনো কথা শুনিস?”
গাব্বু বলল, “অন্য কোনো বাসা হলে সবাই আমাকে সাহায্য করত। উৎসাহ দিত। তোমরা কখনো সাহায্য করো না, উৎসাহ পর্যন্ত দাও না।”
টুনি বলল, “উৎসাহ ছাড়াই আমাদের জীবন শেষ। তোকে উৎসাহ দিলে আমাদের উপায় আছে?”
আবু বললেন, “তোকে উৎসাহ দিই না কে বলেছে?”
গাব্বু বলল, “এই যে এখন এক্সপেরিমেন্টটা করতে দিলে না।”
“এখন কি এক্সপেরিমেন্ট করার সময়?”
“কখনো আমাকে কোনো বৈজ্ঞানিক জিনিস কিনে দাও না।”
“কখন তোকে কী কিনে দিইনি?”
গা মুখ শক্ত করে বলল, “কতদিন থেকে বলছি আমাকে এক বোতল সালফিউরিক অ্যাসিড আর আরেক বোতল নাইট্রিক অ্যাসিড কিনে দিতে, তুমি কিনে দিয়েছ?”
আব্বু বললেন, “দ্যাখ গাব্বু, তোকে আমি সালফিউরিক অ্যাসিড আর নাইট্রিক অ্যাসিড কিনে দেব না। সেই জন্যে তুই যদি বড় হয়ে গ্যালিলিও নিউটন
হয় আইনস্টাইন হতে না পারিস আমি তার সমস্ত দায়-দায়িত্ব নিয়ে নেব। এই পৃথিবীকে একজন কম আইনস্টাইন দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে।”
গাব্বু ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “এই দেখো, তুমি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ।”
আব্বু বললেন, “আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমি খুবই সিরিয়াস।”
“তোমরা খালি দেখ, আমি একবার শুধু বড় হয়ে নিই, তখন আমার বাসায় আমি বিশাল একটা ল্যাবরেটরি বানাব। সেইখানে সবকিছু থাকবে, আমি পুটোনিয়াম পর্যন্ত কিনে আনব।”
মিঠু জানতে চাইল, “পুটোনিয়াম কী ভাইয়া?”
“যেটা দিয়ে নিউক্লিয়ার বোমা বানায়।”
“তুমি নিউক্লিয়ার বোমা বানাবে?”
গাব্বু শীতল গলায় বলল, “খালি একবার বড় হয়ে নিই।”
মিঠু বলল, “ভাইয়া, তুমি বড় হওয়ার একটা ওষুধ তৈরি করে। এক চামুচ খাবে আর এক বছর বড় হবে। দুই চামুচ খাবে আর দুই বছর বড় হবে।”
টুনি হি হি করে হেসে বলল, “ভুলে একদিন পুরো বোতল খেয়ে ফেলবি তখন থুরথুরে বুড়ো হয়ে যাবি।”
গাব্বু এমনভাবে টুনির দিকে তাকাল যে পারলে সে এখনই টুনিকে চোখের দৃষ্টিতে পুড়িয়ে কাবাব করে দেবে।
.
টুনি, গাব্বু আর মিঠু একই স্কুলে পড়ে। স্কুলটা বাসা থেকে খুব বেশি দূরে না, তাই প্রতিদিন তিন ভাইবোন হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার সময় প্রতিদিনই অবশ্যি একই ব্যাপার ঘটে। খানিকদূর হেঁটে যেতে যেতেই গাব্বু পিছিয়ে পড়ে, সে যে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না তা নয়, সে পিছিয়ে পড়ে তার কারণ সবকিছুতেই তার কৌতূহল। সবকিছুই তার দেখতে হয়। আজকেও তাই হচ্ছে। খানিকদূর গিয়ে টুনি আবিষ্কার করল গাব্বু সাথে নেই, পেছনে তাকিয়ে দেখা গেল সে গভীর মনোযোগ দিয়ে কীভাবে রিকশার চাকা পাম্প করা হচ্ছে সেটা দেখছে। টুনিকে ফিরে গিয়ে রীতিমতো তার হাত ধরে টেনে আনতে হল। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর দেখা গেল গাব্বু আবার পিছিয়ে পড়েছে, এবারে সে একটা ওয়ার্কশপে কীভাবে লেদ মেশিনে একটা পাইপকে পালিশ করা হচ্ছে সেটা দেখছে। এবারে মিঠু তাকে ঠেলে সরিয়ে আনল। কিছুক্ষণ পর গাব্বু আবার পিছিয়ে পড়ল, এবারে সে পাখির খাঁচা হাতে একটা মানুষের সাথে আটকা পড়েছে!
স্কুলে পৌঁছানোর পর টুনি আর মিঠু নিজের ক্লাসে চলে গেল, এখন আর তাদেরকে গাল্লুকে নিয়ে টানাটানি আর ধাক্কাধাক্কি করতে হবে না। গাব্বু স্কুলের মাঠ দিয়ে আড়াআড়িভাবে হেঁটে নিজের ক্লাসে গিয়ে জানালার কাছে একটা সিটে নিজের ব্যাগ রেখে ক্লাস থেকে বের হয়ে এল। মাঠে ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলছে, সে কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। রবিন নামে তার ক্লাসের একজন ডাকল, “গা, খেলবি? আয়।”