গাব্বু মাথা নাড়ল, “উঁহু। আমি জেগে থাকব।”
“জেগে থাকবি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
গাব্বু বলল, “কেউ যদি পরপর টানা তিন দিন না ঘুমিয়ে থাকতে পারে তা হলে তার হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। হ্যালুসিনেশান বুঝেছ তো? অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখা যায়–”
টুনি গরম হয়ে বলল, “রাত একটার সময় তোর আমাকে হ্যালুসিনেশান শিখাতে হবে না। আমি জানি হ্যালুসিনেশান কী!” সে বিছানায় উঠে বসে মেঘস্বরে বলল, “তুই যদি এক্ষুনি লাইট নিভিয়ে ঘুমাতে না যাস তা হলে তোর আর হ্যালুসিনেশান দেখার জন্যে তিন রাত জেগে থাকতে হবে না। তুই এক্ষুনি হ্যালুসিনেশান দেখা শুরু করবি।”
গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “এক্ষুনি? কীভাবে?”
“আমি উঠে এসে তোর চুলের ঝুঁটি ধরে এমন কয়েকটা ঝাঁকুনি দেব যে তোর ব্রেন তোর নাক দিয়ে বের হয়ে আসবে।”
এরকম একটা অবৈজ্ঞানিক কথা শুনে গাব্বু খুব বিরক্ত হল, বলল, “ব্রেন কখনো নাক দিয়ে বের হতে পারে না।”
টুনি চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই দেখতে চাস বের হয় কি না? দেখাব এসে?” রীতিমতো হুংকার দিয়ে বলল, “দেখাব?”
গাব্বু বলল, “না। দেখাতে হবে না।”
টুনি বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব-এর মাঝে তুই যদি লাইট নিভিয়ে শুয়ে না পড়িস তা হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।” টুনি গুনতে শুরু করল, “এক।”
গাব্বু বলল, “আপু, আমার কথা শোনো।”
টুনি গাব্বুর কথা শোনার জন্যে কোনো আগ্রহ দেখাল না, বলল, “দুই।”
“তুমি আগে শোনো আমি কী বলি।”
“তিন।”
গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “আপু, তোমার জন্যে আমি একটা কিছু করতে পারি না।”
টুনি বলল, “চার।”
“ইশ! আপু-”
“পাঁচ।”
গাব্বু এবারে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি শুয়ে পড়ছি। খালি আমি একবার বড় হয়ে নিই, তখন দেখব তুমি কী করো।”
টুনি বলল, “ছয়।”
“গাব্বু বলল, তখন আমি তিন দিন না-সাত দিন না ঘুমিয়ে থাকব। তখন দেখব তুমি কী করো।”
টুনি বলল, “সাত।”
গাব্বু তখন লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, টুনি শুনল, শুয়ে শুয়ে গাব্বু বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে।
.
ঠিক তখন রিফাত হাসানও তাঁর হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। তার কারণটা অবশ্যি ভিন্ন, হঠাৎ করে তিনি টের পেয়েছেন এই দেশে তার কোনো আপনজন নেই। পরিচিত মানুষ আছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে কোনো প্রিয়জন নেই। নিজের দেশে যদি একজনও প্রিয়জন না থাকে তা হলে তার মতো দুর্ভাগা কে হতে পারে?
রিফাত হাসান অবশ্যি তখনো জানেন না পরদিন তার সাথে গাব্বু নামের বারো বছরের একটা ছেলের পরিচয় হবে এবং শুধু পরিচয়েই সেটা থেমে থাকবে না!
রিফাত হাসানও তাঁর হোটেল ঘরের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন, হোটেলের জানালা দিয়ে খানিকটা চাঁদের আলো তার বিছানায় এসে পড়ল।
.
০৪.
যে গাব্বুর পরপর তিন দিন তিন রাত না ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল, দেখা গেল ভোরবেলা তাকে কিছুতেই ঘুম থেকে তোলা যাচ্ছে না। আম্মু ডাকলেন, “এই গাবু, ওঠ, স্কুলে যেতে হবে না?”
গাব্বু বিড় বিড় করে কিছু একটা বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেল। আম্মু আবার ডাকলেন, “ওঠ বলছি, ওঠ, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
গাব্বু বিড় বিড় করে আবার কিছু একটা বলল, উঠল না। আম্মু এবার গাব্বুকে ধরে ঝাঁকুনি দিলেন, তখন সে চোখ খুলে তাকাল, ঘুম ঘুম গলায় বলল, “আম্মু, আর এক সেকেন্ড।” তারপর আবার ঘুমিয়ে গেল।
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “আম্মু, তুমি গাব্বুকে তুলতে পারবে না। খামোখা চেষ্টা কোরো না।”
“কেন তুলতে পারব না?”
“গাব্বু সারা রাত জেগে বসে থাকে। কয়েক রাত না ঘুমিয়ে জেগে থাকলে না কী হ্যালুসিনেশান হয়–গাব্বু সেই হ্যালুসিনেশান দেখবে।”
“কী বলিস? মাথা খারাপ দেখি!”
“হ্যাঁ আম্মু। তোমার এই ছেলের পুরোপুরি মাথা খারাপ। তুমি একে ঘুম থেকে তুলতে পারবে না।”
মিঠু কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, বলল, “আমি পারব।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
“দেখবে? এই দেখো।” বলে কেউ কিছু বলার আগেই মিঠু টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা নিয়ে গ্লাসের পুরো পানিটা গাব্বুর শরীরের উপর ঢেলে দিল। গাব্বু তখন তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে চিৎকার করে ওঠে।
মিঠু বলল, “কিছু হয় নাই ভাইয়া। আমি তোমার শরীরে পানি ঢেলে দিয়েছি!”
গাব্বু মিঠুর দিকে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই তুই তুই…” কিন্তু বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
মিঠুকে খুব বিচলিত হতে দেখা গেল না, সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “মনে নাই ভাইয়া তুমি আমাকে বলেছিলে শরীরের মাঝে নার্ভ না কী থাকে, ঠাণ্ডা কিংবা গরম লাগলে কী যেন কী হয়, ব্রেনের মাঝে কী যেন সিগন্যাল যায়”
গাব্বুকে বিজ্ঞানের আলোচনাতেও খুব আগ্রহী হতে দেখা গেল না, নিজের ভেজা শরীরে হাত বুলিয়ে আবার বলল, “তুই তুই তুই…।”
আম্মু বললেন, “ঠিক আছে, যা হওয়ার হয়েছে। এখন ওঠ। স্কুলে যেতে হবে।”
গা মুখ গোঁজ করে বলল, “আমি স্কুলে যেতে চাই না।”
আম্মু বললেন, “স্কুলে না গেলে কেমন করে হবে? ওঠ।–”
গাব্বু খুব অনিচ্ছার সাথে বিছানা থেকে নামল। মিঠু গলা নামিয়ে টুনিকে বলল, “ভাইয়া তো সায়েন্টিস্ট। সায়েন্টিস্টদের সবসময় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তুলতে হয়।”
.
খাবার টেবিলে বসে সবাই নাস্তা করছে, হঠাৎ দেখা গেল গা তার দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে পানির গ্লাসে একটু দুধ ঢেলে নিল। মিঠু চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দিল, “দেখো দেখো, ভাইয়া আবার সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করছে।”