কম বয়সী মেয়েটি গলা উঁচিয়ে বলল, “একটা প্রশ্ন। খালি একটা প্রশ্ন-”
ইউসুফ মুখ কঠিন করে বলল, “না। কোনো প্রশ্ন না। এখন আর কোনো প্রশ্ন না। স্যার যখন সাংবাদিকদের ব্রিফিং করবেন তখন আপনারা আসবেন, যত খুশি প্রশ্ন করবেন। এখন স্যারকে যেতে দিন, প্লীজ।”
সাংবাদিকেরা রিফাত হাসানকে যেতে দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাল না, তখন ইউসুফ সবাইকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে একটু জায়গা করে রিফাত হাসানকে নিয়ে এগুতে থাকে। সাংবাদিকেরা পেছনে থেকে ছুটতে থাকে, ছবি তুলতে থাকে। তার মাঝে কোনোভাবে রিফাত হাসান এয়ারপোর্টের সামনে রাখা গাড়িটাতে উঠে পড়লেন।
গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার পর রিফাত হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবারে বাবা! শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলাম।”
ইউসুফ বলল, “না স্যার। পুরোপুরি ছাড়া পাননি। ওই দেখেন মোটর সাইকেলে করে পিছু পিছু আসছে।”
রিফাত হাসান তাকিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি একটা মোটরসাইকেলে করে দুজন সাংবাদিক গাড়ির পাশাপাশি যেতে যেতে চলন্ত গাড়ির ছবি তোলার চেষ্টা করছে। রিফাত হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির সিটে মাথা রাখলেন। সেভাবে খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে রিফাত হাসান বললেন, “আঠার বছরে দেশের কত পরিবর্তন হয়েছে। আমি কিছুই চিনতে পারছি না!”
ইউসুফ বলল, “আঠার বছর অনেক লম্বা সময় স্যার, এই সময়ে আসলেই অনেক পরিবর্তন হতে পারে।”
“তাই তো দেখছি। কত চওড়া রাস্তা, হাজার হাজার গাড়ি, বড় বড় বিল্ডিং, পুরো শহরটাকেই অচেনা লাগছে।”
“আমাদেরই অচেনা লাগে! আপনার তো লাগতেই পারে–কতদিন পরে এসেছেন।”
রিফাত হাসান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমার আরও আগে আসা উচিত ছিল। এতদিন পরে দেশে এলে দেশ মনে হয় অভিমান করে দূরে দূরে থাকে। অপরিচিতের মতো ভান করে।”
রিফাত হাসানের গলার স্বরে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব ছিল, ইউসুফ তাঁর দিকে একবার তাকাল, কিছু বলল না। রিফাত হাসান অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, “আসলে খুব ছেলেবেলায় আমার বাবা-মা মারা গেছেন–আমি বিদেশে চলে গেছি। আমার দুই ভাইবোন, তারাও বিদেশে, এখানে সে রকম ক্লোজ আত্মীয়স্বজনও নেই। তাই দেশের সাথে সে রকম সম্পর্ক ছিল না। কাজকর্মের এত চাপ, দেশে আসার সময়ও পাইনি।”
ইউসুফ বলল, “এতদিন পর দেশে এসেছেন–আপনার নিজের জন্যে কোনো সময়ই তো দেখছি না, মিটিংয়ের পর মিটিং।”
“হ্যাঁ। একটার পর একটা মিটিং, না হয় সেমিনার।”
“আলাদা কোনো কিছু করার প্ল্যান কি আছে স্যার?”
রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “নাহ্ সেরকম কোনো প্ল্যান নেই! শুধু ছেলেবেলায় যেখানে ছিলাম সময় পেলে সেই জায়গাটা একটু হয়তো দেখে আসতাম।”
“আপনাকে নিয়ে যাব স্যার।”
“তোমাকে নিতে হবে না। আমি নিজেই খুঁজে বের করে নেব।”
ইউসুফ হাসল, বলল, “পারবেন না স্যার। আপনি নিজে নিজে যেতে পারবেন না।”
“কেন পারব না?”
“সাংবাদিকদের উৎপাতে। আগামী তিন দিন সাংবাদিকেরা আপনাকে এক সেকেন্ডও একা থাকতে দেবে না। সারাক্ষণ আপনার পিছু পিছু লেগে থাকবে। এই দেখেন পেছনে একটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি, সামনে আরেকটা। একটা মোটরসাইকেল তো আগেই দেখেছেন-এখন দেখেন দুই নম্বর মোটরসাইকেলও চলে এসেছে। আমি লিখে দিতে পারি এর মাঝে হোটেলে অনেকে পৌঁছে গেছে।”
রিফাত হাসানকে কেমন জানি আতঙ্কিত দেখায়। শুকনো গলায় বললেন, “কেন? আমার পেছনে কেন?”
ইউসুফ বলল, “কারণ আপনি শুধু সেলিব্রেটি না, আপনি হচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। এই দেশে তো রোল মডেলের খুব অভাব, তাই যদি কোনোভাবে একজনকে পেয়ে যায়, তার আর ছাড়াছাড়ি নেই। এই দেশের সব মানুষ আপনার কাজকর্ম ফলো করছে। ফেসবুকে আপনার বিশাল বিশাল ফ্যান ক্লাব, পত্রিকায় প্রত্যেকদিন আপনার ওপর আর্টিকেল বের হচ্ছে!”
“কী বলছ তুমি?”
“আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না স্যার। আগামী তিন দিন আপনি এক সেকেন্ডও একা থাকতে পারবেন না। আমার মনে হচ্ছে পুলিশ প্রটেকশন ছাড়া আপনার বের হওয়া যাবে না।”
রিফাত হাসান শুকনো মুখে বললেন, “কী সর্বনাশ!”
ইউসুফ বলল, “আই অ্যাম সরি স্যার।”
.
হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখা গেল ইউসুফের কথা সত্যি-বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হোটেলের সামনে ভিড় করে আছে। গাড়ি থামতেই তারা ছুটে এল, কয়েকজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করে, কিন্তু ইউসুফ কাউকে কোনো সুযোগ দিল না। রিফাত হাসানকে রীতিমতো টেনে হোটেলের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল। হোটেলের গেটে দারোয়ান কোনো সাংবাদিককে ভেতরে ঢুকতে দিল না, রিফাত হাসান নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।
৩-৪. রাতে টুনি
রাতে টুনি তার টেবিলে বই রেখে পড়ছে, হঠাৎ তার মনে হল কেউ তার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে, তাকিয়ে দেখে গাব্বু। টুনি ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই কী করছিস?”
“দেখছি।”
“কী দেখছিস?”
“তোমার চুল।”
টুনির মাথার লম্বা চুল সত্যি দেখার মতো, তবে সেটা গাব্বুর চোখে পড়বে সেটা টুনি কখনো চিন্তা করেনি। সে বলল, “দেখা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“এখন যা। ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলবি না।”
গাব্বু বলল, “আপু, আমাকে একটা জিনিস দেবে?”
“কী জিনিস?”
“আগে বল, দেবে।”
“না জেনে কেমন করে বলব? আগে শুনি তারপর দেখি দেওয়া যায় কী না।”