আব্বু তখন টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বললেন, “এই তোরা দেখে যা। বাংলাদেশী সায়েন্টিস্টকে দেখাচ্ছে।”
টুনি আর মিঠু দেখার জন্যে ছুটে এল, গাব্বু বেশি গা করল না। বিজ্ঞান নিয়ে তার অনেক আগ্রহ, বিজ্ঞানী নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা নেই। তা ছাড়া কোনো এক জায়গায় সে পড়েছে টেলিভিশন দেখলে মানুষের সৃজনশীলতা কমে যায়, তাই সে কখনো টেলিভিশন দেখে না।
দেখা গেল পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের একজন মানুষ এয়ারপোর্টের করিডর ধরে হেঁটে আসছেন এবং অনেক সাংবাদিক তাকে হেঁকে ধরেছে। মানুষটাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে, সাংবাদিকদের কথা শুনে যেন বুঝতে পারছেন না কী বলতে হবে। আব্বু ভলিউমটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন, সবাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করল সাংবাদিকেরা কী প্রশ্ন করে আর বৈজ্ঞানিক রিফাত হাসান কী বলেন।
.
০২.
রিফাত হাসান এয়ারপোর্টে নেমে সত্যি সত্যিই একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি মোটেও আশা করেননি এয়ারপোর্টে এতজন সাংবাদিক হাজির হবে। তাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে তাঁর চোখ রীতিমতো ধাঁধিয়ে গেল। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মন্ত্রণালয়ের যে জুনিয়র অফিসারটা এসেছে সে অনেক কষ্টে সাংবাদিকদের ঠেলে রিফাত হাসানের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার আমি আপনাকে নিতে এসেছি। আপনার সাথে আমার ই-মেইলে যোগাযোগ হয়েছিল।”
রিফাত হাসান মনে হয় একটু ভরসা পেলেন, বললেন, “তুমি ইউসুফ?”
“জি স্যার।”
“থ্যাংক গড।” তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত সাংবাদিক কেন এসেছে?”
“আপনি স্যার একজন ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। সাংবাদিকেরা তো আসবেই।”
“আমি আবার সেলিব্রেটি হলাম কবে থেকে?”
“কী বলেন স্যার! সারা পৃথিবী আপনাকে এখন এক নামে চেনে।”
“কে বলেছে? মোটেও সারা পৃথিবী চেনে না। আমি ইউনিভার্সিটির মাস্টার, অন্য মাস্টারদের সাথে যোগাযোগ আছে, সাধারণ পাবলিক আমাকে চিনবে কেন? সাধারণ পাবলিক চেনে ফিল্মস্টারদের। ফুটবল প্লেয়ারদের। তারা হচ্ছে। সেলিব্রেটি।”
ইউসুফ মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের দেশে আপনি হচ্ছেন আসল সেলিব্রেটি। ফেসবুকে আপনাকে নিয়ে কী হইচই হয় আপনি জানেন না?”
“উঁহু, জানি না।” রিফাত হাসান আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সাংবাদিকেরা তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তেজী চেহারার একটা মেয়ে একেবারে তার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে বলল, “আপনি কতদিন পর দেশে এসেছেন?”
রিফাত হাসান কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি যে পার্টিকেল আবিষ্কার করেছেন তার নাম কী?” একই সাথে আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “এই পার্টিকেলটাকে কী রিফাত পার্টিকেল ডাকবে?” তার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখন কী নিয়ে গবেষণা করছেন?” সিরিয়াস ধরনের একজন কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল, “বাংলাদেশে কি বিজ্ঞানচর্চার সত্যিকারের সুযোগ আছে?” কমবয়সী একটা মেয়ে সবার গলাকে ছাপিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আপনি মনে করেন।”
রিফাত হাসান একেবারে হকচকিয়ে গেলেন, এতজন সাংবাদিকের এতগুলো প্রশ্ন, তিনি কোনটি ছেড়ে কোনটির উত্তর দেবেন? হাত তুলে বললেন, “আস্তে! আস্তে! সবাই একসাথে প্রশ্ন করলে তো আমি কারও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারব না!”
কম বয়সী মেয়েটি গলা উঁচিয়ে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন–”
তার গলা ছাপিয়ে আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতদিন পর দেশে এসেছেন?”
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রশ্ন থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সোজা, তাই রিফাত হাসান এই প্রশ্নটার উত্তর দিলেন, বললেন, “আঠার বছর।”
“এতদিন পর দেশে এসে আপনার কেমন লাগছে? আপনি কী কী পরিবর্তন দেখছেন?”
“আমি এখনো এয়ারপোর্ট থেকেই বের হতে পারিনি, তাই এখনো কিছুই দেখতে পারিনি। অনুমান করছি দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফর এক্সাম্পল, এই এয়ারপোর্টটাই অনেক বড় আর আধুনিক হয়েছে। নিশ্চয়ই দেশেও এরকম আরো অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”
সবাইকে ঠেলে মুশকো জোয়ান টাইপের একজন সাংবাদিক সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতদিন দেশে থাকবেন?”
রিফাত হাসান বললেন, “তিন দিন। আমি তিন দিনের জন্যে দেশে এসেছি।”
“মাত্র তিন দিন? আঠার বছর পরে এসে আপনি মাত্র তিন দিন থাকবেন?”
রিফাত হাসান একটু থতমত খেয়ে বললেন, “আমি আবার আসব। তখন আমি সময় নিয়ে আসব। আমি কথা দিচ্ছি এর পরের বার আসতে আমার আর আঠার বছর লাগবে না।”
তেজী চেহারার মেয়েটা বলল, “এই তিন দিন আপনার প্রোগ্রাম কী?”
“আমি বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে এসেছি, তাই বেশির ভাগ সময় দেব এই মন্ত্রণালয়ের সাথে। এ ছাড়াও আমি দেশের অধ্যাপক-গবেষকদের সাথে কথা বলব। দুটি ইউনিভার্সিটিতে দুটি টক দিতে হবে–”
মুশকো জোয়ান সাংবাদিকটা কনুই দিয়ে অন্যদের ঠেলে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণা নিয়ে আপনার একটা কমেন্ট প্লীজ–”
রিফাত হাসান মাত্র এসেছেন, এ ধরনের বিষয় কিছুই জানেন না, কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না, তখন বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র অফিসার ইউসুফ তাঁকে রক্ষা করল। সে রিফাত হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এখন আপনারা স্যারকে যেতে দিন প্লীজ। স্যার অনেক লম্বা ফ্লাইটে এসেছেন, খুবই টায়ার্ড। হোটেলে গিয়ে স্যার রেস্ট নেবেন। কাল সকালে স্যারের জরুরি মিটিং।”