“নায়েগ্রা ফলসের।”
“নায়েগ্রা ফলস কী?”
“অনেক বড় একটা জলপ্রপাত।”
“ছবিটা দেখাবে আপু?”
“আমার টেবিলের ওপর ভিউকার্ডটা আছে। দেখে নিস।”
মিঠুর অবশ্যি দেরি সহ্য হল না, তখন তখনই উঠে গিয়ে কার্ডটা নিয়ে এল। সবাই ছবিটা দেখল, টুনি কার্ডের উল্টোপিঠের চিঠিটা একনজর দেখে বলল, “মিথিলা চিঠিতে আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লিখেছে।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী?”
টুনি পড়ে শোনাল, “তুই কী জানিস আমেরিকাতে বাংলাদেশের একজন বৈজ্ঞানিককে নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে?”
“রিফাত হাসান!” আব্বু মাথা নাড়লেন, “আমি পত্রিকায় পড়েছি, কী একটা জিনিস জানি আবিষ্কার করেছেন।”
টুনি গাব্বুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গাব্বু, তুই জানিস?”
গাব্বু কার্ডটার দিকে তাকিয়ে ছিল, বাতাসের চাপের একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে তার ঠিক এই সাইজের একটা কার্ড দরকার। কী নিয়ে কথা হচ্ছিল সে খেয়াল করেনি। অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আপু, তোমার এই কার্ডটা আমাকে দেবে?”
টুনি ধরেই নিল নায়েগ্রা ফলসের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গাব্বু কার্ডটা চাইছে, তাই সে গাবুকে কার্ডটা দিয়ে দিল। কোনোকিছুর সৌন্দর্য নিয়ে গাবুর কোনো উৎসাহ আছে বলে বাসার কেউ জানে না।
গাব্বু দ্রুত খাওয়া শেষ করে পানি খেল, তারপর জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটাকে কানায় কানায় ভরে নিল। আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হচ্ছে গা? গ্লাসে এত পানি ভরছিস কেন? পানি খাবি কেমন করে?”
গাব্বু বলল, “পানি খাব না।”
“তা হলে?”
মিঠু বুঝে গেল, হাততালি দিয়ে বলল, “এক্সপেরিমেন্ট! ভাইয়ার আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট! তাই না ভাইয়া?”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “এটা খুবই সোজা এক্সপেরিমেন্ট। এই দেখ।”
গাব্বু কানায় কানায় ভরা গ্লাসটার ওপর ভিউকার্ডটা রাখতেই টুনি চিৎকার করে বলল, “তুই ভিউকার্ডটা নষ্ট করছিস কেন?”
গাব্বু বলল, “তুমি এই কার্ডটা আমাকে দিয়ে দিয়েছ। এখন এটা আমার–আমি এটা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।”
“তাই বলে নষ্ট করবি?”
গাব্বু কোনো উত্তর না দিয়ে গ্লাসটাকে উপুড় করে ফেলল, ভিউকার্ডটা থেকে হাত সরিয়ে ফেলার পরও পানিটা গ্লাসে আটকে রইল, পড়ে গেল না। মিঠু
আনন্দে চিৎকার করে বলল, “এক্সপেরিমেন্ট! সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।”
গাব্বু রাজ্য জয় করে ফেলার মতো একটা ভঙ্গি করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ, পানির চাপ কীভাবে পানিটাকে আটকে রেখেছে!”
মিঠু হাততালি দিয়ে বলল, “সায়েন্টিস্ট! ভাইয়া হচ্ছে সায়েন্টিস্ট!”
আম্মু ভয়ে ভয়ে বললেন, “ঠিক আছে। এক্সপেরিমেন্ট তো হয়েছে, এখন গ্লাসটা সোজা করে ফেল। হঠাৎ করে যদি পানি পড়ে যায় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
গাব্বু কঠিন মুখ করে বলল, “কখনো পড়বে না আম্মু। কখনো পড়বে না। তুমি সায়েন্সকে বিশ্বাস কর না? বাতাসের একটা চাপ আছে? এই চাপ পানিটাকে আটকে রেখেছে। এইটা তো ছোট একটা গ্লাস–এই গ্লাসটা যদি তিরিশ ফুট লম্বা হত তা হলেও আটকে রাখতে পারত।”
আবু বললেন, “ঠিক আছে গাব্বু। আমরা বিশ্বাস করে ফেললাম। এখন এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে ফেল। দেখে ভয় লাগছে।”
গাব্বু বলল, “কোনো ভয় নাই। যতক্ষণ পৃথিবীতে বাতাস আছে ততক্ষণ বাতাসের চাপ আছে, আর যতক্ষণ বাতাসের চাপ আছে ততক্ষণ কোনো ভয় নাই। এই দেখো–”
বলে গাব্বু উল্টো করে ধরে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটাকে রীতিমতো একটা ঝাঁকুনি দিল এবং সত্যি সত্যি কিছুই হল না। গাব্বু বিজয়ীর মতো সবার দিকে তাকাল এবং ঠিক তখন কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ ঝপাৎ করে পুরো গ্লাসের পানি টেবিলের ওপর পড়ে গেল। টেবিল থেকে পানি মাছের ঝোলের সাথে মিশে ছিটকে এসে সবার চোখে-মুখে গায়ে এসে লাগে। বাড়তি কিছু পানি টেবিল থেকে গড়িয়ে টুনির কোলে এসে পড়ল, বাকিটুকু গড়িয়ে আব্বুর দিকে যাচ্ছিল, আব্বু লাফিয়ে সরে গেলেন।
মিঠু শুধু আনন্দে চিৎকার করতে থাকে, “এক্সপেরিমেন্ট! সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”
টুনি চিৎকার করে লাফিয়ে কুঁদিয়ে একটা বিশাল হইচই শুরু করে দিল, “আবু আম্মু তোমরা দেখেছ? দেখেছ? দেখেছ গাব্বু কী করল? আমার এত সুন্দর টি-শার্টটা-দিল বারোটা বাজিয়ে। তোমরা কিছু বল না দেখে গাবুটা এত সাহস পেয়েছে। দিন নাই রাত নাই খালি এক্সপেরিমেন্ট আর এক্সপেরিমেন্ট।”
আব্বু হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, আম্মু টেবিলের থই থই পানি, মাছের ঝোল আর ডাল পরিষ্কার করতে লাগলেন, শুধু মিঠু আনন্দে চিৎকার করতে লাগল, “এক্সপেরিমেন্ট। সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”
.
সোফায় বসে চা খেতে খেতে আব্বু টেলিভিশন দেখছিলেন–অবশ্যি দেখছিলেন বললে কথাটা ভুল বলা হবে, ঠিক করে বলা উচিত, একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছিলেন। বিদঘুঁটে গান, বাংলা সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল আর কয়েকটা মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন দেখে বিরক্ত হয়ে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ করে একটা চ্যানেলে খবর পেয়ে গেলেন। আব্বু খুব খবর শুনতে পছন্দ করেন, তাই খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর শুনতে লাগলেন।
প্রথমে রাস্তায় শ্রমিকদের সাথে পুলিশদের একটা দুর্ধর্ষ মারপিটের দৃশ্য দেখাল, না বলে দিলে এটাকে সিনেমার একটা দৃশ্য বলে মনে হত। তারপর একটা কাগজের গোডাউন পুড়ে যাওয়ার খবর দেখাল, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে সেই দৃশ্যটি দেখানোর সময় সাংবাদিকের চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছিল যেন আগুনে কিছু পুড়ে যাওয়া খুব মজার ব্যাপার। তারপর একটা বাস দুর্ঘটনার খবর শোনাল, খবরের পর সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আঁতেলটাইপের কিছু মানুষের প্যানপ্যানানি অনেকক্ষণ ধরে শুনতে হল। তারপর টেলিভিশনে সেজেগুঁজে থাকা মেয়েটা একটু ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলতে শুরু করল, “যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর রিফাত হাসান তিন দিনের সফরে আজকে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। এয়ারপোের্ট থেকে আমাদের সংবাদদাতার বিশেষ রিপোর্ট…–”