মোবাইল ফোন আর ক্যালকুলেটরের বিষয়টা একটু জটিল। সে বইয়ে পড়েছে লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লের মাঝে পোলারাইজার থাকে, একটা পোলারাইজার ব্যবহার করার তার অনেকদিনের শখ। ক্যালকুলেটর খুলে সে এক টুকরো প্লাস্টিকের মতো জিনিস বের করেছে, সেটা পোলারাইজার কি না তা বোঝার জন্যে তার আরেকটা পোলারাইজার দরকার। গাব্বু ভাবছিল হয়তো টুনির মোবাইলের ওপরে একটা পোলারাইজার থাকতে পারে। সেটা যখন খোলার চেষ্টা করছে ঠিক তখন টুনি এসে হাজির, সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি হইচই! গাব্বুকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করারই সুযোগ দিল না।
আজকে খাবার টেবিলে সবার সামনে আলোচনাটা শুরু হয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হল, যে কথাগুলো গাব্বু আগে বলতে পারেনি এখন সেটা বলা যাবে। কাজেই সে গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করল, “আপু, তুমি যেগুলো বলেছ সেগুলো সত্যি না। আসলে হয়েছে কী–”
আম্মু তখন ভাতের চামচ দিয়ে টেবিলে ঠাস করে মেরে বললেন, “ব্যস! অনেক হয়েছে। দিনরাত শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া। তোরা কি কখনো মিলে মিশে থাকতে পারবি না?”
গাব্বু বলল, “আম্মু, আমি মোটেই ঝগড়া করছি না।”
আম্মু গলা উঁচিয়ে বললেন, “আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। মুখ বন্ধ করে খা–”
এরকম একটা অবৈজ্ঞানিক কথা, গাব্বু প্রতিবাদ না করে পারল না, মুখ বন্ধ করে মানুষ কেমন করে খাবে? সে বলল, “আম্মু, মুখ বন্ধ করে খাওয়া অসম্ভব। ইন্টার ভেনাস–”
আম্মু টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, “আর একটাও কথা না!”
কাজেই সবাই চুপ করে খেতে শুরু করল। গাব্বু আজকেই জেনেছে কেমন করে লবণের মাঝে আয়োডিন আছে কি নেই সেটা পরীক্ষা করা যায়। এর জন্যে দরকার কয়েকটা ভাত, এক টুকরো লেবু আর একটুখানি লবণ। টেবিলের ওপর সবকিছু আছে, গাব্বু চাইলেই সেই এক্সপেরিমেন্টটা করতে পারে, কিন্তু এখন সাহস করল না। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে টুনি এত কিছু বলেছে, মিঠুও নালিশ করেছে, তার মাঝে এক্ষুনি যদি সে আবার এক্সপেরিমেন্টটা করা শুরু করে তা হলে তার উপর দিয়ে শুধু ঝড় না, সাইক্লোন শুরু হয়ে যেতে পারে।
কিছুক্ষণের মাঝেই আব্বু আর আম্মু পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। ভাগ্যিস দেশে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা প্রত্যেকদিনই কিছু না কিছু অঘটন করছে, পলিটিশিয়ানরা ঝগড়াঝাটি করছে। তাই আব্বু-আম্মুদের মতো বড় মানুষদের আলাপ করার একটা বিষয় আছে, তা না হলে তারা কী নিয়ে আলাপ করতেন কে জানে! যখন গাব্বু দেখল তার দিকে আর কেউ নজর দিচ্ছে না তখন সে তার প্লেটের কোনায় কয়েকটা ভাত নিয়ে তার মাঝে লেবুর টুকরো থেকে চিপে লেবুর রস ফোঁটা ফোঁটা করে মিশিয়ে দিল, তারপর সেখানে খানিকটা লবণ দিয়ে পুরোটা আচ্ছা করে কচলে নিতে শুরু করে। গাব্বু ভাবছিল, সে কী করছে কেউ খেয়াল করবে না, কিন্তু মিঠু ঠিকই দেখে ফেলল, আর চিৎকার করে বলল, “ভাইয়া এক্সপেরিমেন্ট করছে, ভাইয়া আবার এক্সপেরিমেন্ট করছে!”
সবাই তখন ঘুরে গাব্বুর দিকে তাকাল। গাব্বু ইতস্তত করে বলল, “আমি মোটেও এক্সপেরিমেন্ট করছি না। আমি একটা দরকারি জিনিস পরীক্ষা করে দেখছি।”
আব্বু জানতে চাইলেন, “কী জিনিস?”
“লবণে আয়োডিন আছে কি না। আয়োডিন ছাড়া লবণ খেলে গলগণ্ড রোগ হয়।”
মিঠু জানতে চাইল, “গলগণ্ড রোগ কী?”
আব্বু বললেন, “গলা ফুলে যাওয়ার একরকম রোগ।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলি? লবণে আয়োডিন আছে?”
গাব্বু বলল, “যদি এই লবণটা বেগুনি হয়ে যায় তা হলে বুঝবে লবণে আয়োডিন আছে।”
সবাই তখন গাব্বুর প্লেটের কোনায় তাকাল, প্রথমে কিছু হল না, তারপর হঠাৎ করে লবণটুকু ঠিক বেগুনি না হয়ে নীল হয়ে গেল। আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “গাব্বু তো ঠিকই বলেছে। লবণটা তো দেখি আসলেই বেগুনির মতো হয়ে গেল।”
মিঠু চোখ বড় বড় করে বলল, “ভাইয়া, তুমি হচ্ছ সায়েন্টিস্ট।”
গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি এখনো সায়েন্টিস্ট হই নাই। আমি বড় হলে সায়েন্টিস্ট হতে চাই।”
টুনি বলল, “তুই এখনো সায়েন্টিস্ট হোস নাই তাতেই আমাদের বাসার সবার জীবন শেষ। যখন তুই সায়েন্টিস্ট হবি তখন কী অবস্থা হবে চিন্তা করতে পারিস? তখন শুধু বাসার না, সারা দেশের সব মানুষের জীবন নষ্ট করে দিবি।”
গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কক্ষনো না। সায়েন্টিস্টরা কক্ষনো মানুষের জীবন নষ্ট করে না।”
“তুই করিস।”
“করি না।”
টুনি জোর গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আব্বু থামিয়ে দিলেন, বললেন, “ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। এখন থাম। তোদের জ্বালায় শান্তিমতো খেতেও পারি না।”
কাজেই টুনি আর গার সবাইকে শান্তিতে খেতে দেওয়ার জন্যে চুপ করে যেতে হল। আব্বু আর আম্মু আবার খানিকক্ষণ পলিটিক্স নিয়ে কথা বললেন, তারপর গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কথা বললেন, তারপর ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ে কথা বললেন, তখন টুনি বলল, “জানো আম্মু, মিথিলা আমেরিকা থেকে একটা ভিউকার্ড পাঠিয়েছে। কী সুন্দর ভিউকার্ড!”
মিথিলা ওদের ফুপাতো বোন, ফুপার বিশাল গার্মেন্টসের ব্যবসা। ভীষণ বড় লোক, ছুটিছাটাতে তারা ইউরোপ-আমেরিকা বেড়াতে চলে যায়। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী লিখেছে মিথিলা?”
“এই তো, কত মজা করছে এইসব।”
মিঠু জানতে চাইল, “কার্ডে কীসের ছবি আপু?”