প্রিন্সিপালের ঘরে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে গাবুর সাথে প্রফেসর রিফাত হাসানের কথা শুনছিল। গাব্বু এমনভাবে প্রফেসর রিফাত হাসানের সাথে কথা বলছে যেন দুজন সমবয়সি বন্ধু। কী সহজ একটা ভঙ্গি, কী আশ্চর্য!
রিফাত হাসান এবারে ঘুরে অফিস ঘরের অন্যদের দিকে তাকালেন। একটু হাসার ভঙ্গি করে বললেন, “আপনারা নিশ্চয়ই স্কুলের টিচার?”
রওশন ম্যাডাম বললেন, “জি। আমি গাব্বুর টিচার।” তারপর গালুর আব্বু-আম্মুকে দেখিয়ে বললেন, “আর এঁরা হচ্ছেন স্যার বাবা-মা।”
রিফাত হাসান চোখ বড় বড় করে বললেন, “ওয়ান্ডারফুল! শুধু যে গাব্বুর সাথে দেখা হল তা না। গাব্বুর বাবা-মায়ের সাথেও দেখা হয়ে গেল! চমৎকার!”
আবু-আম্মু কী বলবেন বুঝতে না পেরে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আম্মু বললেন, “কাল গাব্বু আপনার কথা বলছিল।”
“আমিও সবাইকে গাব্বুর কথা বলেছি।” রিফাত হাসান আম্মুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, “ইয়াং সায়েন্টিস্ট একটা ওয়ান্ডারফুল জিনিস, কিন্তু বাবা-মায়ের বারোটা বেজে যায়!”
আব্বুও গলা নামিয়ে বললেন, “আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।”
“আমার বাবা-মা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। একটু সহ্য করেন।”
আম্মু হাসার চেষ্টা করলেন, “আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু শুধু আমরা করলে তো হয় না–অন্যেরা আছে।”
রিফাত হাসান অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ এবং হঠাৎ করে প্রিন্সিপালের রুমে, গাব্বু গাব্বুর বাবা-মা, গাব্বুর ক্লাস টিচার, ছাত্রছাত্রী কেন হাজির হয়েছে তার কারণটা অনুমান করে ফেললেন। তিনি গাব্বুর দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, তোমার খবর কী?”
গাব্বু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, “খবর ভালো না।”
“ভালো না? সে কী! কেন?”
“আমাকে টিসি দিয়ে–”
প্রিন্সিপাল স্যার গাব্বুকে কথাটা শেষ করতে দিলেন না, মাঝখান থেকে গলা উঁচিয়ে বললেন, “স্যার বসেন। একটু চা খান।”
“না, না, চা খেতে হবে না। আমি গাব্বুর কথাটা শুনি। তার কী সমস্যা?”
প্রিন্সিপাল স্যার গলা উঁচিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “কোনো সমস্যা নাই স্যার। কোনো সমস্যা নাই। আমি থাকতে গাব্বুর এই স্কুলে কোনো সমস্যা হবে আপনি বিশ্বাস করেন?”
“অবশ্যই করি না।” রিফাত হাসান ব্যাপারটা নিয়ে আর অগ্রসর হলেন না। কোনো সমস্যা হয়ে থাকলেও সেটা যে মিটে যাবে কিংবা মিটে গেছে সেটা তিনি অনুমান করে ফেললেন। বললেন, “প্রিন্সিপাল সাহেব, গাব্বুর মতো এরকম ক্রিয়েটিভ ছেলে আপনার স্কুল থেকে বের হয়েছে সেটা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। আমরা কী ঠিক করেছি জানেন?”
“জি স্যার।”
“আমি আমার ইউনিভার্সিটির সাথে কথা বলেছি। আমরা ঠিক করেছি, আপনার স্কুলে চমৎকার একটা ল্যাব করে দিব। একটা ওয়ার্কশপসহ। সবকিছু থাকবে। সম্ভব হলে ক্রিয়েটিভ ছেলেমেয়েদের জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করব।”
“থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ স্যার।” প্রিন্সিপাল স্যার হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “আমরাও চেষ্টা করি স্যার। আমরাও উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। এই যে দেখেন আজকেই আমরা আলোচনা করছিলাম-” প্রিন্সিপাল স্যার টেবিল থেকে গাব্বুর দুষ্কর্মের তালিকা লেখা কাগজটা তুলে রিফাত হাসানকে দেখিয়ে বললেন, “এই যে দেখেন, আজকেই আমরা আলোচনা করছিলাম। গালু একদিনে ছয়টা বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছে। অসাধারণ! আমরা কী ঠিক করেছি জানেন স্যার?”
“কী?”
“আমরা স্যার স্কুল থেকে গাব্রুকে একটা মেডেল দিব। ইয়াং সায়েন্টিস্ট মেডেল।”
রিফাত হাসান বললেন, “ভেরি গুড। চমৎকার।”
গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তা হলে আমাকে আর টিসি দিবেন না স্যার! বলছিলেন যে টিসি দেবেন?”
রিফাত হাসান জানতে চাইলেন, “টিসি জিনিসটা কী?”
খুব একটা বড় রসিকতা হচ্ছে এরকম ভঙ্গি করে প্রিন্সিপাল হা হা করে হাসলেন, বললেন, “টিসি মানে অনেক কিছু হতে পারে স্যার। কারও জন্যে টিসি হচ্ছে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। মানে স্কুল থেকে বিদায়, আর কারও জন্যে টিসি মানে টেন্ডার কেয়ার। মানে আলাদা করে যত্ন। আমাদের গাব্বুর জন্যে টিসি মানে হচ্ছে টেন্ডার কেয়ার। সবসময় টেন্ডার কেয়ার।”
এইবার লিটন একটু এগিয়ে এল, বলল, “কিন্তু স্যার একটু আগে যে বলছিলেন–”
প্রিন্সিপাল স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহ্! চুপ করো দেখি। দেখছ না আমরা কথা বলছি? বড়দের মাঝে কথা বলবে না।”
মিলি বলল, “তা হলে গাব্বু আমাদের সাথে থাকবে?”
“অবশ্যই থাকবে। আমরা কি গাব্বুকে অন্য কোথাও যেতে দেব? দেব না।”
রিফাত হাসান এবার গাব্বুর বন্ধুদের দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই গাব্বুর সাথে পড়?”
সবাই মাথা নাড়ল। রিফাত হাসান বললেন, “আমার তো শুধু গাবুর সাথে পরিচয় হয়েছে, তোমাদের সাথে পরিচয় হলে হয়তো দেখতাম তোমরাও গাবুর মতো সায়েন্টিস্ট।”
লিটন মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমাদের ক্লাসে শুধু গাব্বু হচ্ছে সায়েন্টিস্ট।”
“অন্যরা? অন্যরাও নিশ্চয়ই কিছু না কিছু?”
লিটন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। এই যে রবিন, সে ফাটাফাটি ক্রিকেট খেলে। মিলি চোখ বন্ধ করে পরীক্ষা দিলেও ফার্স্ট হয়। ফারিয়া খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। রত্না কবিতা লিখতে পারে।”
“তুমি?”
“আমি কিছু পারি না।”