প্রিন্সিপাল স্যার চোখ লাল করে বললেন, “তুমি বলতে চাও যে এত বড় একটা অন্যায় করেও তোমার ভেতরে কোনো অপরাধবোধ নেই?”
গাব্বু ইতস্তত করে বলল, “স্যার, এইটা একটা সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট ছিল স্যার। অন্যায় ছিল না স্যার।”
“অন্যায় ছিল না? তা হলে এই লিস্টের শেষ ঘটনাটা কী ছিল? যখন তুমি তোমার ক্লাসরুমের পর্দায় আগুন লাগিয়ে দিলে? সারা স্কুলে হইচই ছোটাছুটি কেলেঙ্কারি? আমি নিজে জানালা থেকে এই ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা উদ্ধার করেছি।” কথা শেষ করে প্রিন্সিপাল স্যার ড্রয়ার থেকে বড় একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে দেখালেন। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, “কী ছিল সেই ঘটনা?”
গাব্বু বলল, “এইটাও সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট। আর একটু অ্যাকসিডেন্ট।”
“কোনটা এক্সপেরিমেন্ট? কোনটা অ্যাকসিডেন্ট?”
গাব্বু তখন তার নিজের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করল কীভাবে কনভেক্স লেন্সের বিষয়টা দেখানোর জন্যে সে একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করিয়েছিল, আর সেটা ভুলে যাওয়ার কারণে কীভাবে লেন্সের উপর রোদ পড়ে আগুন জ্বলে গিয়েছিল। সে বার বার করে বলল সে মোটেও ইচ্ছে করে করেনি, আগুন জ্বলে যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু না।
প্রিন্সিপাল স্যার এরকম সময়ে গাব্বুর আব্বু আর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা তো নিজের কানে শুনলেন, নিজের চোখে দেখলেন। এখন আপনারাই বলেন এরকম একজন ছেলেকে কী আমার স্কুলের ছাত্র হিসেবে রাখা সম্ভব? না কী রাখা উচিত?”
আব্বু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি খুবই দুঃখিত। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম হবে না।”
আম্মুও সায় দিলেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমরা কথা দিচ্ছি।” প্রিন্সিপাল স্যার শীতল চোখে কিছুক্ষণ তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “তার জন্যে খুব দেরি হয়ে গেছে। আমি আপনাদের ডেকেছি আপনাদের ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।”
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, “নিয়ে যাওয়ার জন্যে!”
“হ্যাঁ। নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আমি অফিসে বলে রেখেছি তারা আপনার ছেলের জন্যে টিসি টাইপ করছে। টিসিসহ আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যান।”
প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে যারা ছিল সবাই একসাথে চমকে উঠল। রওশন ম্যাডাম ব্যস্ত হয়ে বললেন, “এটা আপনি কী বলছেন স্যার? টিসি দেবেন কেন? একটু বকা দিয়ে ছেড়ে দেন। গাব্বু খুব ব্রাইট। লেখাপড়াতে ভালো। শুধু সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে নিজে বিপদে পড়ে, অন্যদেরও বিপদে ফেলে দেয়। এ ছাড়া তার আর কোনো সমস্যা নেই। ওকে কোনোভাবেই টিসি দিয়ে একেবারে স্কুল থেকে বিদায় করে দেওয়া ঠিক হবে না স্যার।”
রওশন ম্যাডাম যখন কথা বলছিলেন তখন সব ছেলেমেয়ে তার কথার সাথে সাথে মাথা নাড়তে লাগল। গাবুর কাজকর্মের কারণে তাদের নানারকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় সত্যি, কিন্তু তার জন্যে তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে সেটা তারা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
প্রিন্সিপাল স্যার রওশন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিসেস রওশন, আপনি একটা খুব বড় জিনিস মিস করে যাচ্ছেন। আপনি তো নিজেই দেখলেন তার বিরুদ্ধে একটা দুইটা না, ছয়টা অভিযোগ। যারা অভিযোগ করেছে তারা সবাই এখানে হাজির, কোনোটাই মিথ্যা অভিযোগ না। সব সত্যি। একেবারে হাতেনাতে প্রমাণিত। অথচ আপনার এই ছাত্র সেগুলোর জন্যে দুঃখিত না। তার ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই। শুধু যে অনুশোচনা নেই তা নয়, পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তার ভিতরে এক ধরনের আনন্দ। সে আনন্দে হাসছে। হাততালি দিচ্ছে। আপনি চিন্তা করতে পারেন? আমি যদি নিজের চোখে না দেখতাম তা হলে বিশ্বাসই করতাম না যে আমার স্কুলে এরকম একজন ছাত্র আছে।”
রওশন ম্যাডাম আবার চেষ্টা করলেন, বললেন, “স্যার, প্লীজ ব্যাপারটা একটু। অন্যভাবে দেখেন। হি ইজ ভেরি ক্রিয়েটিভ।”
রত্না, মিলি আর ফারিয়াও গলা মেলাল, বলল, “মাফ করে দেন স্যার। আমরা আর কখনো নালিশ করব না।”
লিটন বলল, “জি স্যার মাফ করে দেন।”
রবিন বলল, “গাব্বুর মনটা খুব ভালো স্যার। শুধু একটু পাগলা টাইপের।”
প্রিন্সিপাল মাথা নাড়লেন, বললেন, “নো। হি হ্যাঁজ টু গো। তাকে এই স্কুল থেকে বিদায় হতে হবে। এখন আর তাকে রাখা সম্ভব হবে না। এই ছেলেকে আমাদের স্কুলের প্রয়োজন নেই।”
রওশন ম্যাডাম বললেন, “প্লীজ স্যার। আরেকটা সুযোগ দেন। ওয়ান লাস্ট টাইম।”
প্রিন্সিপাল স্যার গর্জন করে উঠলেন, “ইম্পসিবল! হি ইজ আউট। স্কুল থেকে বিদায়।”
ঠিক এরকম সময় একজন পিয়ন ছুটতে ছুটতে এল, চাপা গলায় বলল, “স্যার! পুলিশ!”
প্রিন্সিপাল স্যার চমকে উঠলেন, “পুলিশ? পুলিশ কেন?”
পিয়ন মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না স্যার।”
প্রিন্সিপাল স্যার জানালা দিয়ে তাকালেন, দেখলেন সত্যি সত্যি তার অফিসের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে। সেখান থেকে বেশ কয়েকজন পুলিশ নামছে।
প্রিন্সিপাল স্যার পুলিশ দেখেই নার্ভাস হয়ে গেছেন। যদি নার্ভাস না হতেন তা হলে দেখতে পেতেন পুলিশের গাড়ির পেছনে একটা দামি গাড়ি। সেখান থেকে যারা নামছে তাদের সবাইকে না চিনলেও একজনকে ঠিকই চিনতেন, দেশের সবাই কয়েকদিনে তাকে চিনে গেছে।