আব্বু বললেন, “এই ছেলেমেয়েদের এখানে ডেকে আনার কোনো দরকার ছিল না। আপনার যা বলার কথা সোজাসুজি আমাদেরকে বলতে পারতেন।”
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “না। আমি চাই সবাই শুনুক। জানুক। আমাদের কী সমস্যা হচ্ছে সেটা আপনারা সবাই জানেন।”
“আমি খুবই দুঃখিত যে আমার ছেলের কারণে আপনার স্কুলে সমস্যা হচ্ছে। আমি কথা দিচ্ছি আমি ব্যাপারটা দেখব।”
আম্মুও মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ। আমরা ব্যাপারটা দেখব।”
“সেটা পরের ব্যাপার। আগে দেখা যাক তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ রয়েছে।” প্রিন্সিপাল স্যার কাগজটা তার নাকের কাছে নিয়ে পড়লেন, “এক-দুই তিনজনকে সে ব্যথা দিয়েছে।”
আম্মু চমকে উঠলেন, “ব্যথা দিয়েছে?” আম্মু গাব্বুকে খুব ভালোভাবে জানেন, তাকে নিয়ে হাজার রকম যন্ত্রণা থাকতে পারে, কিন্তু সে কাউকে ব্যথা দিতে পারে সেটা তিনি কোনোভাবে বিশ্বাস করতে পারেন না। বললেন, “গাব্বু কাউকে ব্যথা দিতে পারে সেটা আমার বিশ্বাস হয় না।”
প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেই আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন।”
আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, তুই কাউকে ব্যথা দিয়েছিস?”
গাব্বু দুর্বল গলায় বলল, “আম্মু, ব্যথা দিয়েছি একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে?”
“কী এক্সপেরিমেন্ট?”
গাব্বু এক্সপেরিমেন্টটা ব্যাখ্যা করল, কেন কীভাবে চিমটি দিয়েছে সেটা বোঝালো। সবকিছু শুনে আব্বু বলল, “তাই বলে তুই একজনকে ব্যথা দিবি?”
প্রিন্সিপাল স্যার মনে করিয়ে দিলেন, “একজনকে নয়। তিনজনকে। দুইজনকে চিমটি, একজনকে রুলার দিয়ে গুঁতো।”
গাব্বু নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। বোঝা গেল অভিযোগ সত্যি। প্রিন্সিপাল স্যার কাগজ দেখে বললেন, “দ্বিতীয় অভিযোগ অনেক গুরুতর। তুমি একটা মেয়ের মাথার চুল কেটে নিয়েছ?”
গাব্বু কোনো কথা বলল না। প্রিন্সিপাল স্যার ধমক দিয়ে বললেন, “কথা বল।”
গাব্বু তখন কথা বলল, “হাইগ্রোমিটার বানানোর জন্যে আমার লম্বা চুল দরকার। কেউ দিতে রাজি হয় না, তখন ফারিয়াকে অনেক কষ্ট করে রাজি করিয়েছি।”
“আর তার মাথার চুল কেটে নিয়েছ?”
“সব না। অল্প কয়েকটা।”
“মোটেও অল্প কয়েকটা না, এক খাবলা চুল কেটে নিয়েছ। আমি নিজের চোখে দেখেছি।”
গাব্বু একটা নিশ্বাস ফেলল, “যখন কাটছিলাম তখন নড়ে উঠল, তাই–”
“কার চুল কেটেছ? নাম কী?”
“ফারিয়া।”
“ফারিয়া কোথায়? সামনে এসো।”
ফারিয়া সামনে এসে দাঁড়াল। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, “তোমার মাথার কাটা চুল দেখাও।”
ফারিয়া ভয়ে ভয়ে তার মাথার চুল সরিয়ে দেখাল এক জায়গায় এক খাবলা চুল নেই। গাব্বু বলল, “ফারিয়া তুই চাইলে আমি তোর চুলগুলো তোকে দিয়ে দিতে পারি।”
ফারিয়া বলল, “আমি কাটা চুল দিয়ে এখন কী করব?”
প্রিন্সিপাল কাগজটা আবার তুললেন, “এর পরের অভিযোগটা আরও গুরুতর। গাব্বু ক্লাসের এক ছাত্রীকে এমন ভয় দেখিয়েছে যে মেয়েটা প্রায় মেন্টাল কেস হয়ে গেছে।”
আব্বু-আম্মু কথাটা শুনে এত অবাক হলেন যে বলার মতো না। তারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালেন।
প্রিন্সিপাল স্যার ডাকলেন, “যে মেয়েটিকে ভয় দেখিয়েছে সে কোথায়? সামনে এসো।”
রত্না দুই পা এগিয়ে গেল। প্রিন্সিপাল স্যার বললেন, “এবারে বল কী হয়েছে। কোনোকিছু বাদ দেবে না।”
রত্না কোনো কথা না বলে দাঁড়িয়ে রইল। প্রিন্সিপাল স্যার হুংকার দিলেন, =!!”কী হল? কলাগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা বল।”
রত্না তখন শুরু করল, “ক্লাসের সবাই জানে আমি মাকড়সাকে খুব ভয় পাই। খু-উ-ব বেশি ভয় পাই। গাব্বু সেটা জানে। সকালবেলা এত বড় একটা মাকড়সা হাত দিয়ে ধরে আমার মুখের সামনে ধরেছে।”
প্রিন্সিপাল স্যারের চোখগুলো আনন্দে জ্বলজ্বল করতে থাকে। রত্নাকে বললেন, “কী হয়েছে? থামলে কেন? বল। বলতে থাকো।”
রত্না বলল, “মাকড়সাটা যখন ধরেছে তখন আমি ভয়ে চিৎকার করছি। আর গাব্বু তখন বলছে তিন দশমিক এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ চার–”
গাব্বুর মুখ হঠাৎ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, সে হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেরেছে! পেরেছে!”
প্রিন্সিপাল স্যার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, “কী পেরেছে?”
“পাইয়ের মান দশমিকের পর নয় ঘর পর্যন্ত বলতে পেরেছে। আগে পারত না।”
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ?”
গাব্বু বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করল, “রত্না অনেক বার বলেছে সে কিছু মনে রাখতে পারে না। চেষ্টা করলেও ভুলে যায়। আমি তখন তাকে বলেছি আমি তাকে মনে রাখা শিখিয়ে দেব, পাইয়ের মান নয় ঘর পর্যন্ত সে মনে রাখতে পারবে। এখন দেখেছেন স্যার সে নয় ঘর পর্যন্ত গড়গড় করে বলে গেল।”
প্রিন্সিপাল স্যার মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তার সাথে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখানোর কী সম্পর্ক?”
গাব্বু অনেকটা লেকচার দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “মানুষ যখন ভয় পায় তখন ব্রেনের যে অংশটা কাজ করে তার নাম হচ্ছে এমিগডালা। ভয় পাওয়ার সময় যে ঘটনা ঘটে মানুষের ব্রেন সেটা খুব ভালো করে মনে রাখতে পারে। সেই জন্যে আমি রত্নাকে যখন পাইয়ের মানগুলো বলছিলাম তখন একইসাথে মাকড়সা দিয়ে ভয় দেখাচ্ছিলাম। এমিগডালা কাজ করেছে স্যার, রত্নার সব মনে আছে। সাকসেসফুল এক্সপেরিমেন্ট।”